
‘এক কেজির মাছের দাম ২ হাজার ৬০০ টাকা, এইটা কোনো কথা! দুই কেজি খাসির মাংসের দামও তো এর চেয়ে কম।’
‘কী করুম কন আপা? দাম কইতেও তো খারাপ লাগে। কিন্তু কিনিই তো বেশি দামে।’
‘এইটা কোনো কথা না!’
‘ঠিক বলছেন আপা। আমি ১৭ বছর ধইর্যা মাছের বিজনেস করি। ইলিশের এমন দাম দেহি নাই।’
ক্রেতা নাহিদা ইসলামের সঙ্গে ইলিশ মাছ বিক্রেতা আকতারুজ্জামানের কথোপকথন এমনই ছিল। স্থান, রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রেলগেটসংলগ্ন মাছের বাজার। ৪ আগস্ট (সোমবার) বেলা সোয়া ১১টা। এখানে ভোর থেকে পাইকারি মাছের বাজার বসে। পরে বাজার লাগোয়া ফুটপাতে বসে মাছের দোকান। দিনভর দোকানগুলো থাকে। তবে সন্ধ্যায় দোকানের সংখ্যা বেড়ে যায়।

কারওয়ান বাজারের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী নাহিদা অফিসের ফাঁকে মাছ কিনতে এসেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, এ সময় ক্রেতা কম থাকেন। হয়তো কিছুটা কম দামে ইলিশ কিনতে পারবেন। কিন্তু দাম শুনে আর না কিনেই ফিরে গেলেন।
শুধু কারওয়ান বাজারের এই মাছের বাজারটিই নয়, কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের নিচের মাছের বাজার, মোহাম্মদপুর বাজার, বিজয় সরণির কলমীলতা বাজার—একাধিক বাজারে গিয়ে একটি সাধারণ দৃশ্য এখন প্রায়ই চোখে পড়ে। আর তা হলো, ইলিশের দোকানির সঙ্গে দাম নিয়ে ক্রেতাদের উচ্চ স্বরে কথাবার্তা, দামাদামির একপর্যায়ে ‘সৌভাগ্যবান’ ক্রেতাদের মাছ কেনা। তবে যে পরিমাণ বা যে ওজনের মাছ কিনতে চান ক্রেতা, তার চেয়ে কম ওজন বা পরিমাণের মাছ কিনে ফেরা; দাম শুনে ইলিশ কিনতে না পেরে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি।
এবার ইলিশের দাম সত্যিই অস্বাভাবিক। এ দেশে ইলিশের প্রাচুর্য আছে। তারপরও এর এত দাম মেনে নেওয়া যায় না।
এমন নয় যে ইলিশ কেনা নিয়ে বাজারের এ অবস্থা এবারই দেখা যাচ্ছে। চরম আয়বৈষম্যের এই সমাজে ইলিশের মতো মহার্ঘ হয়ে ওঠা মাছ পেতে গাঁটে প্রচুর পয়সা থাকতে হবে, সবাই যে এর নাগাল পাবেন না, এটা নতুন নয়। কিন্তু এবারের মতো দাম আর কখনো ছিল কি না, অনেক পুরোনো বিক্রেতা তা স্মরণ করতে পারেন না। আবার অনেক দিন ধরে বাজারঘাট করছেন, এমন বয়স্ক ক্রেতারাও বলছেন, ইলিশের এমন দাম তাঁরা দেখেননি।
রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র ইলিশ বিক্রি হচ্ছে অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি দামে। কিন্তু এর অনেকটাই ভিন্নচিত্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাজারগুলোতে। সেখানকার বাজারগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশের প্রাচুর্যের দেশ বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাজারগুলোতে ইলিশের দাম এ বছর কম। একে ‘খুব দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা ইলিশ বিশেষজ্ঞ আনিছুর রহমান। প্রায় এক দশক ধরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে ইলিশের প্রজননের সময় এ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তার নেতৃত্বে ছিলেন আনিছুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘এবার ইলিশের দাম সত্যিই অস্বাভাবিক। এ দেশে ইলিশের প্রাচুর্য আছে। তারপরও এর এত দাম মেনে নেওয়া যায় না।’
ভারতের সঙ্গে একসময়ে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা
সামুদ্রিক নানা প্রজাতির মাছের অবাধ প্রজনন আর জাটকা সংরক্ষণে এত দিন বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ছিল ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই। আর ভারতীয় জেলেদের জন্য ছিল ১৫ এপ্রিল থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত। এতে যে ঘটনাটা ঘটত সেটা হলো, বাংলাদেশে জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সময় হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন, তখন ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরার সুযোগ পেতেন।
আর এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারণে দাবি করে আসছিলেন বাংলাদেশের জেলেরা। সেই দাবি মেনে নিষেধাজ্ঞার সময় নিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। চলতি বছর থেকে বাংলাদেশে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা চালু হয় ভারতের সঙ্গে মিল রেখে। তবে তাতে কতটুকু লাভ হয়েছে, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
পশ্চিমবঙ্গের বাজারে ৭০০ গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশের কেজি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা); এক কেজির ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ রুপির মধ্যে (বাংলাদেশি মুদ্রায় দাম ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে)।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমি প্রায় বাধ্য হয়েই সরকারের ডাকা বৈঠকে নতুন সময় মেনে নিয়েছি। আমাদের দেওয়া সময়টাই ছিল অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের নীতিনির্ধারণী স্তরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো।’ তাঁর মতে, আলোচনা করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভারতের সময়ের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার সময় মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত কতটুকু ভালো হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ইলিশের বাজার
ইলিশ বাঙালির প্রিয় মাছ। সে বাঙালি বাংলাদেশ, ভারত বা বিশ্বের যেখানেই থাকুন। বাংলাদেশের মতো ভারতের সমুদ্র এবং সমুদ্রসংলগ্ন নদীতে ইলিশ ধরা পড়ে। ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে উপকূলে ইলিশ ধরা পরে অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে বাংলাদেশের চেয়ে তা অনেকটাই কম। তবে এবার বাংলাদেশের চেয়ে কলকাতাসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের দাম অপেক্ষাকৃত কম।
ঢাকার খুচরা বাজারে ৫০০ গ্রামের ছোট ইলিশ কিনতে গেলেও প্রতি কেজিতে ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা লাগছে। একাধিক বাজারে একই রকম চিত্র। গত জুলাই থেকে চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮৫০ থেকে ২ হাজার টাকায়। আর এক কেজি বা বড় ইলিশের কেজি শুরুই হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকা থেকে। আকারভেদে এটি ৩ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠছে।
কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মো. সুমন বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) প্রথম আলোকে বলেন, ৫০০ গ্রাম বা এর বেশি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। ৭০০ গ্রামের ওপরে হলে প্রতি কেজি তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। আর ৮০০ গ্রামের ওপরে গেলে সেগুলো ২ হাজার ১০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়; এক কেজি হলে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং দেড় কেজিরগুলো ২ হাজার ৮০০ টাকা করে কেজি বিক্রি হচ্ছে।

কলকাতা এবং হাওড়ার একাধিক বাজার ঘুরেছেন প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি। দেখা গেছে, কলকাতায় ৫০০ গ্রামের একটি ইলিশের দাম ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫০ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় বিবেচনা করলে এর দাম হয় ১ হাজার ৫০ টাকার মতো; অর্থাৎ এই আকারের মাছের দাম পশ্চিমবঙ্গের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে কেজিতে অন্তত ৪০০ টাকা কম।
পশ্চিমবঙ্গের বাজারে ৭০০ গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশের কেজি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা); এক কেজির ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ রুপির মধ্যে (বাংলাদেশি মুদ্রায় দাম ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে)।
চলতি বছর থেকে বাংলাদেশে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা চালু হয় ভারতের সঙ্গে মিল রেখে। তবে তাতে কতটুকু লাভ হয়েছে, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
কলকাতার মাছ আমদানিকারকদের সংগঠন ফিস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতুল দাস প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এ বছর আমাদের বঙ্গোপসাগর উপকূল এলাকায় ইলিশের সরবরাহ অপেক্ষাকৃত কম। তবু ইলিশের বাজার ঠিক রাখতে এই রাজ্যে মিয়ানমারের ইরাবতী নদীর ইলিশ আসছে।’ তিনি জানালেন, এক কেজির বেশি ওজনের এসব ইলিশ প্রতি কেজি দেড় হাজার রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে গুজরাট ও মুম্বাই উপকূলের বড় আকারের (ওজন এক থেকে দুই কেজি) ইলিশ কিছুটা কম দামে প্রতি কেজি এক হাজার রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে স্থানীয় ১ কেজি বেশি ওজনের ইলিশের দাম তুলনামূলক চড়া—১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ রুপি কেজি। তবে বাজারে বেশির ভাগই মিয়ানমারের ইলিশ।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে যায়নি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের ইলিশের বিশেষ কদর আছে। রাজ্যের ব্যবসায়ী থেকে ভোক্তা—সবাই এ ইলিশের জন্য অপেক্ষায়। অতুল দাস বলছিলেন, ‘আমরা চাইছি, এবারও বাংলাদেশ সরকার ১৫ আগস্টের পর ইলিশ রপ্তানি করুক। এই লক্ষ্যে আবেদনও করা হয়েছে।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইলিশ মাছ রপ্তানির অনুরোধ জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ভারত থেকে প্রস্তাব এসেছে বলে শুনেছি। ...আমার কাছে কোনো কিছু আসেনি। এ প্রস্তাবের কথাটাও আমি পত্রিকায় দেখেছি।’