
৭ আগস্ট ২০২৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি মোড় ঘুরানো দিন। মাত্র দু’দিন আগেই শেখ হাসিনার দীর্ঘ সময়ের শাসনের অবসান ঘটেছে। গোটা দেশ দুলছে পরিবর্তনের ঢেউয়ে— যার নায়ক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থীরা। আর দৃশ্যপটের কেন্দ্রে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেইসঙ্গে নতুন ভোরের প্রতীক্ষায় উদ্বেলিত একটি জাতি।
কেন্দ্রবিন্দুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস
সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে ব্রিটিশ পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, ‘এই দায়িত্ব ছাত্রদের আহ্বানে নিতে যাচ্ছি। অন্তর্বর্তী মেয়াদ শেষে ক্ষমতায় থাকার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।’ প্যারিস থেকে ঢাকার পথে রওয়ানা হওয়ার আগে তার এই বার্তা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির আমন্ত্রণে ফ্রান্সে অবস্থানরত ইউনূস দেশে ফেরেন ৮ আগস্ট। আর সেদিন রাতেই তার নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে চলতে থাকে ট্রাফিক ও পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি
ঢাকার রাজপথে তখনও শিক্ষার্থীরাই মূল চালিকাশক্তি। কেউ রাস্তা পরিষ্কার করছে, কেউ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করছে, কেউ আবার সংসদ ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। ‘আমরা শুধু সরকার পতন চাইনি, আমরা চেয়েছি একটি ন্যায্য সমাজ। সেই দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে’- বলেন আন্দোলনের অন্যতম মুখ সারজিস আলম। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শিক্ষার্থীদের এই ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ‘তোমরা এই দেশের সন্তান, তোমরাই এই দেশ গড়বে।’
ভেঙে পড়ে প্রশাসনিক কাঠামো, বাড়তে থাকে চুরি-ডাকাতি
সরকার পতনের পর পুলিশ প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। থানাগুলোতে পুলিশ নেই, সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে। যে দুয়েকজন ছিলেন তারাও ভয়ে কোথাও বের হচ্ছিলেন না। ফলে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় দেখা দেয় চুরি-ডাকাতির ভয়াবহতা। ‘ডিবির টর্চার সেল’ বিতর্ক এবং সেনা অভিযানে উদ্ধার হওয়া ১৩ লাখ টাকা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।
পদত্যাগের হিড়িক
শেখ হাসিনার বিদায়ের পর পরই বিচার বিভাগ, আর্থিক খাত, রাজস্ব বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, এমনকি ক্রীড়াঙ্গনেও একের পর এক পদত্যাগের ঘটনা ঘটতে থাকে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মো. মোরশেদ— দু’জনই ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নরও পদত্যাগপত্র জমা দেন। গভর্নর রউফ তালুকদার অনুপস্থিত থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরব হন তার পদত্যাগ ও বিচার দাবিতে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নির্বাচন কমিশন (ইসি)— সবখানেই একধরনের ‘ভূতুড়ে পরিবেশ’ বিরাজ করতে থাকে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য, প্রক্টর, পরিচালকরা একযোগে পদত্যাগ করেন ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে।
‘আয়নাঘর’ থেকে ফিরে আসা মুখ ‘মাইকেল চাকমা’
রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটি ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমার পাঁচ বছর তিন মাসের অন্তর্ধানের পর ফিরে আসা। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত গোপন স্থানে তাকে আটক রাখা হয়েছিল বলে দাবি করে ইউপিডিএফ। তার মুক্তি একদিকে রাষ্ট্রীয় গুমের প্রশ্নে নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়, অন্যদিকে পাহাড়ে নতুন একটি রাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের পালানোর হিড়িক
দেশের ভেতরে অস্থিরতার মধ্যেই শুরু হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের গণপলায়ন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দিল্লিতে অবস্থান করছেন। সাবেক মেয়র তাপস, সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, নিক্সন চৌধুরী, রুহুল হকসহ অর্ধশতাধিক সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী দেশ ছেড়ে গেছেন বলেও জানা যায়। তবে পালাতে গিয়ে বাধার মুখেও পড়েন অনেকে। বিমানবন্দরে আটক হন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ছাত্রলীগ নেতা সৈকত ও রিয়াজ, এমনকি সদ্য সাবেক ডিজিএফআই কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানও।
দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়ার প্রকাশ্যে ভিডিও বার্তা
দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে ভিডিও বার্তায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, ‘এই আন্দোলনকারীরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তারা শুধু আমাকে নয়, পুরো জাতিকে মুক্ত করেছে।’ তবে বার্তার শেষে তিনি সকলকে ধ্বংস, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ পরিহারের আহ্বানও জানান।
অন্তর্বর্তী সরকার চূড়ান্ত রূপরেখা আসছে— জানালেন সমন্বয়করা
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ও নাহিদ ইসলাম জানান, রাতের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সরকারে থাকছে নাগরিক সমাজ, ছাত্র প্রতিনিধি, অর্থনীতি ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
বন্ধ ভারতীয় ভিসা সেন্টার, সীমান্তে অচলাবস্থা
চলমান অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলো (আইভিএসিএস) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ৬ আগস্ট এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত কোনো আবেদন নেওয়া হবে না। এ ছাড়া, যারা পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন, তাদের তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ফলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য ভারতে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
একটি দেশ নতুন যাত্রাপথ খুঁজছে
এখন সব চোখ অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণার দিকে। এই সরকার শুধু একটি নির্বাচন আয়োজনের জন্য নয়, বরং একটি ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ বা নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরির জন্যও নিয়োজিত হতে পারে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যেন একটি যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যেখানে আতঙ্ক ও আশার আলো, পালাবদল ও প্রতিরোধ এবং সবচেয়ে বড় করে বললে— জনগণের জাগরণের সাক্ষী হতে চলেছে এই ভূ-খণ্ড।
সারাবাংলা