Image description
জুলাই অভ্যুত্থানের ১ বছর

জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচার বিভাগে বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এনেছে। এর মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দৃশ্যমান হওয়ায় বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। তবে সুপ্রিমকোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় বিচার-সংশ্লিষ্টদের মাঝে অস্বস্তিও রয়ে গেছে। পৃথক সচিবালয় না হওয়ায় অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নসহ বেশ কিছু বিষয় অমীমাংসিত থাকলেও আশা ছাড়েনি সুপ্রিমকোর্ট।

সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার মোয়াজ্জেম হোছাইন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতি যে রোডম্যাপ দিয়েছিলেন, কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে, আর কিছু কাজ চলমান রয়েছে। যেমন সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। আশা করছি সুপ্রিমকোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় হলে অনেক বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে। যেমন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নের বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল, এ ব্যাপারে একটা রুলস প্রক্রিয়াধীন। পৃথক সচিবালয় হলে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের বিষয়টিও সেখানে সমাধান হবে।

‘দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবিতে সুপ্রিমকোর্টে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ ছিল বছরজুড়ে। সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ বেশ কিছু বিচারপতিকে অপসারণও করা হয়। এবছর পুরোনো কিছু মামলা শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। মামলাগুলো নিষ্পত্তির ফলে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা কয়েকজন রাজনীতিবিদ কারামুক্তি পান।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই-আগস্টের দমন-পীড়নে ভূমিকার জন্য দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচারের জন্যও ইতোমধ্যে আইন সংশোধন করা হয়েছে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও প্রস্তাব : জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি কমিশন গঠন করে। কমিশনের ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ৩১টি অধ্যায়ে বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে নানা সুপারিশ ও প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। অধ্যায়গুলোর মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগ ও শৃঙ্খলা; সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয়, আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ, স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন; স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস; বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা; আদালত ব্যবস্থাপনা; বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘব; বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ; মামলাজট হ্রাস; মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ এবং বিচারাঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্তকরণ-এমন বিষয় রয়েছে।

প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ : এদিকে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টে উভয় বিভাগের বিচারপতি ও জেলা জজদের উপস্থিতিতে অভিভাষণ বক্তব্যে বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পৃথককরণ বিষয়ে আলোকপাত করেন। অভিভাষণে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলেন। বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দেন। এছাড়া গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিচার বিভাগে মেধা চর্চার উন্মেষ, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে উন্নত দেশসমূহের মতো সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে দুর্নীতি রোধ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক বিচার সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের উদ্যোগ নেওয়ার দিকনির্দেশনা দেন।

জানতে চাইলে সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আইন মন্ত্রণালয় গত একবছরে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। আইন সংস্কার হিসাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ সংশোধন, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সংশোধন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন করে আগের সাইবার নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক ধারাগুলো এবং এসবের অধীনে দায়ের মামলাগুলো বাতিল করা হয়েছে। তাছাড়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালা ও বিবাহ নিবন্ধন বিধিমালা সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।

বিচারপতি নিয়োগে জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল : আইনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বেশ কিছুসংখ্যক ‘অতিরিক্ত বিচারক’ নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। ৫৯ জন প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছে কাউন্সিল। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের রাষ্ট্রপতি বরাবর সুপারিশ পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি সেটি অনুমোদন করলে গেজেট আকারে প্রকাশ করবে আইন মন্ত্রণালয়।

রাজনৈতিক দল অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি : গত ১০ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন। প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, সংশোধনীর পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা রাখা হয়েছে। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) মনে করে, এটি একটি যথোপযোগী উদ্যোগ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের চার মামলার বিচার শুরু : জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে গুম-খুন-নির্যাতনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ এসেছে ৪৫০টি। এখন পর্যন্ত যে ৩০টি মামলা হয়েছে, এর মধ্যে ২৩টি বিবিধ মামলা বা মিস কেস। আর চারটি মিস কেস নিয়মিত মামলায় রূপ নিয়েছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২০৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৮৪ জনকে। এখনো পলাতক ১৩২ জন। ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে, এর মধ্যে ২৩টি বিবিধ মামলা বা মিস কেস। চারটি মিস কেস নিয়মিত মামলায় রূপ নিয়েছে। এ চারটির মধ্যে নির্দেশদাতা হিসাবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। যার সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত আছে। আর রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা মামলার ওপেনিং স্টেটমেন্ট ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য একটি মামলা রেখেছেন আদালত। এছাড়া আশুলিয়ায় ছয় আন্দোলনকারীকে পোড়ানো এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলা দুটিও আগস্টে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।

দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের অপসারণ : আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট’ বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবিতে গত বছরের ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগের ‘দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ। আর ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারপতিদের অনতিবিলম্বে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি-লিগ্যাল উইং। এদের দাবির মুখে ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখে সুপ্রিমকোর্ট। এর আগে ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগপত্র জমা দেন। প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য পাঁচ বিচারপতি হলেন এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।