Image description
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

নির্বাচনের নিশ্চিত গন্তব্য এখন ফেব্রুয়ারি। ফলে ৬ মাস বাকি থাকলেও কার্যত নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। যারা ইতোমধ্যে নিজের প্রার্থিতা নিশ্চিত করে ফেলেছেন তারা কালক্ষেপণ না করে ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন। বাকিরা প্রার্থিতা নিশ্চিতের গ্রিন সিগন্যাল পেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী রমজানের আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট আয়োজনের ঘোষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের সময় নিয়ে যেমন সব ধরনের ধোঁয়াশা কেটে গেছে, তেমনি ভোটের রাজনীতিও গড়িয়েছে মাঠে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এবার যেহেতু স্মরণকালের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে; ফলে স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভোটারদের কদর হবে সবচেয়ে বেশি। প্রার্থীদেরও জনগণের কাছে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। উপরন্তু তরুণ ভোটারদের অনেকে এই প্রথমবার ভোট দিতে যাচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রার্থীদের জন্য নানামুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের সঠিক প্রার্থী বাছাই ভোটের মাঠে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিতে পারে। এছাড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির সামনের সারিতে থাকা বিএনপির মতো বড় দলের দায়-দায়িত্বও অনেক বেশি বলে বিবেচিত হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে ঐক্য ধরে রেখে রাজপথের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের নিয়ে কিভাবে নির্বাচনি বৈতরণী পার হবে এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জাতীয় সরকার গঠন করার নানা চ্যালেঞ্জ দলটিকে রাজনীতির অভিভাবকের ভূমিকায় দাঁড় করিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনের মাঠে বিএনপি অনেক এগিয়ে রয়েছে। রাজনীতি ও ভোটের মাঠে এ মুহূর্তের সবচেয়ে বৃহৎ দল হওয়ার কারণে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যাও অনেক বেশি। এজন্য ভোটারদের কাছে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা বেশ আগেভাগেই নির্বাচনি আসনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা যুগান্তরকে জানান, বড় দল হিসাবে প্রতিটি আসনে বিএনপির একাধিক প্রার্থী থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার এখন প্রার্থী ঠিক করাও সবচেয়ে বড় কাজ। ইতোমধ্যে কয়েকটি জরিপ চালানো হয়েছে। এখন তৃতীয়বারের মতো জরিপ চলছে। তবে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো সিনিয়র ও ডাকসাইটে নেতা রয়েছেন, যাদের প্রার্থিতা শতভাগ নিশ্চিত। বাকি আসনগুলোতে প্রার্থী কাদের করা হবে তা নির্ধারণ করতে হাইকমান্ডের নির্দেশে জরিপের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই চলছে। এছাড়া দীর্ঘ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে থাকা সমমনা দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জন্য কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে ২৯৬টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। প্রার্থীরা নিজ এলাকায় নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগের প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। গণঅধিকার পরিষদও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রথম ধাপে ৩৬টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও ২২৩টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এদিকে গণ-অভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) নির্বাচন প্রস্তুতি থেকে পিছিয়ে নেই। দলটির অন্তত ৪০ জন সম্ভাব্য প্রার্থী নিজ এলাকায় যাচ্ছেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এবার নির্বাচন আগের মতো গতানুগতিক হবে না। ভোট যেহেতু অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে-ফলে প্রতিটি ভোটারের কাছে প্রার্থীদের ঠিকঠাক পৌঁছাতে হবে। ভোটারের মন জয় ছাড়া ভোট পাওয়া যাবে না বলে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বেশি সময় ব্যয় করতে হবে। আবার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ভোটাররা যে ধরনের প্রার্থী পছন্দ করেন সেই মানের প্রার্থীও মনোনয়ন দিতে হবে। ফলে প্রার্থী নির্বাচনে দল ভুল করলে প্রত্যাশিত ফলাফল ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নতুনত্বসহ নানা দিক বিবেচনায় নিতে হবে। এবার মনে রাখতে হবে, অনেক ভোটার শুধু মার্কা দেখে ভোট নাও দিতে পারেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থীদের গণমানুষ ও তারুণ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। এছাড়া রাজনৈতিক দলকে প্রার্থী নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার ডেলিগেশন, সততা ও যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেখতে হবে গত ১৫ বছরের লড়াইয়ে সে ছিল কিনা। এখন মানুষ দেখতে চায় যারা প্রার্থী হবেন তাদের নেতৃত্ব, যোগ্যতা, ভিশন এবং দক্ষতা।

বিশ্লেষকরা আরও বলেন, গত এক বছরে রাজনৈতিক মাঠ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এই উন্মুক্ত মাঠে খেলার ধরন কি হবে, খেলাটা কার পক্ষে যাবে তা অত সহজে আগে প্রাক্কলন করা কঠিন। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক ভুল করে ফেলতে পারে। যদি অভিজ্ঞ লোক রাজনৈতিক দলগুলোর পাশে না থাকে তাহলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল হয়ে যেতে পারে। এ কারণে নির্বাচনে দলের ব্যাপক গ্রহযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রার্থীর অগ্রহণযোগ্যতার কারণে ফলাফল সেভাবে পক্ষে নাও আসতে পারে। এবার যারা ভালো ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দিতে পারবে, তারাই জয়ের পথে এগিয়ে যাবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, গতানুগতিক ধারায় যে নির্বাচনি প্রচারণা চলে আসছিল, সেটা এবার পরিবর্তিত হয়ে যাবে। স্যোশাল মিডিয়া পুরো নির্বাচনজুড়ে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। এটা নিয়ন্ত্রণ করার কাঠামো আমাদের এখনো তৈরি হয়ে ওঠেনি। এটি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এছাড়া এবার রাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রার্থিতা নেওয়ার ক্ষেত্রে নতুনত্ব আসতেই হবে। পেশিশক্তি এবং আর্থিক কারণে আগে যেমনভাবে প্রার্থী হতো, এবার তা নাও হতে পারে। এবার প্রার্থী মনোনয়নে যেসব বিষয় প্রাধান্য পাবে-সেগুলো হলো গণমানুষ ও তারুণ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং রাজপথের আন্দোলনের ভূমিকা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা সারা দেশের সব সংসদীয় আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন। বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য পুরোদমে প্রস্তুত। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করছেন। তিনি বলেন, বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেননি। তাই ভোটারদের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। বিএনপি এবার ত্যাগী এবং অধিকতর গ্রহণযোগ্য জনপ্রিয় নেতাদের প্রার্থী দেবে। তাই সর্বজন গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর যাচাই-বাছাই করা হবে।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল। অতীতে সব গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ ও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল। সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনি প্রস্তুতি চলছে। তবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে।

ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ বলেন, ‘এক বাক্সে ভোট’ নীতি নিয়ে আমরা দৃঢ় আশাবাদী। এখন আমাদের মতো করে দল গোছানোর জন্য প্রার্থী ঘোষণা করব। তারা প্রচারণাসহ সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। নির্বাচনের আগে জাতীয় স্বার্থে কোনো দলকে কোনো আসন ছেড়ে দিতে হলে নির্দ্বিধায় আমরা তা করব।

সমমনাদের সঙ্গে কাল থেকে বিএনপির বৈঠক : নির্বাচনের সময় ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর আরও তৎপরতা বেড়েছে। দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ আসনে যেতে শুরু করেছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে সমমনাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসাবে শুক্রবার গুলশান কার্যালয়ে ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠকে বসছে দলটি। এতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি থাকবেন। জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের অনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে। ১২ দলীয় জোট দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির পরীক্ষিত মিত্র। নির্বাচন নিয়েই হয়তো আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী, তাদের নিজ এলাকায় কাজ করতে এবং সেখানে জনমত তৈরি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (আজ) জোটের বৈঠক রয়েছে। সেখানে কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হবেন তাসহ নানা বিষয়ে কথা বলব।

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যন নুরুল ইসলাম মনি বলেন, এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি খুব দরকার। পরিবেশটা যাতে সুষ্ঠু ও সুন্দর থাকে সেজন্য সবার কাজ করা উচিত। এ ব্যাপারে সরকারের আরও সিরিয়াস হওয়া দরকার। অনেকে বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক কথা বলে, কিন্তু আমরা তা সহনশীলতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করি। এখন পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মুখে এমন একটা কথাও কেউ শোনেননি, যেটা কাউকে আহত কিংবা ক্ষতি করেছে। এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকে, গণতন্ত্রের যাতে উত্তরণ ঘটাতে পারি তার জন্য সবাই মিলে কাজ করা দরকার। সেজন্য বড় দল হিসাবে বিএনপি যে ধরনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব, তা সবই করছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সম্ভাব্য নির্বাচনি অঞ্চলগুলোতে গণসংযোগের কাজ অব্যাহত আছে। নির্বাচনের সময় নির্ধারণ হওয়ায় এখন আরেকটু জোরদার করছি। তবে নির্বাচনের সম্ভাব্য অঞ্চল ও প্রার্থিতা এখনো চূড়ান্ত করিনি। চূড়ান্তভাবে কয়টা আসনে নির্বাচন করা যাবে, নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্র মঞ্চ, বিএনপি বা অন্যদের সঙ্গে সমঝোতা বা বোঝাপড়াটা কোন লেভেলে, কোন পর্যায়ে হবে আগামীতে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যা সমাধান করতে হবে।