Image description

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী বিশেষ করে বিএনপি ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সন্তুষ্ট করার প্রবল চেষ্টা করা হয়েছে। এই ঘোষণাপত্র মূলত অভ্যুত্থানকারীদের সাংবিধানিক সুরক্ষা ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও তা সাম্প্রতিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এছাড়া এই ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলের সমালোচনা করা হলেও এর আগের কর্তৃত্ববাদকে তুলে ধরা হয়নি বলেও মত দিয়েছেন তারা।

ঘোষণাপত্রে বিএনপি-এনসিপিকে সন্তুষ্ট করা হয়েছে, দাবি বিশ্লেষকদের

 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। জুলাই ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি দলিল, যার মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে।ঘোষণাপত্রে বলা হয়, দেশি-বিদেশি চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ১/১১-এর ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়।

জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মামুন আল মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এর মধ্যে নতুন কিছু নেই। প্রথাগত আওয়ামী বিরোধিতা আছে। বিএনপিকে সন্তুষ্ট করার জন্য এক-এগারো সরকারকে ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা বলেছে।’

 

‘এছাড়া এই জুলাই ঘোষণার মধ্য দিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট হলো যে তারা বুঝতে পেরেছেন সংবিধান সংশোধনের ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই’, বলেন তিনি।

ঘোষণাপত্রে বিএনপি-এনসিপিকে সন্তুষ্ট করা হয়েছে, দাবি বিশ্লেষকদের

রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপি ও এনসিপির বিষয়টি যেভাবে এসেছে অন্যান্য শক্তিগুলোর ভূমিকা সেভাবে আসেনি।’

তিনি বলেন, ‘এই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়াদের একটি পক্ষ ছিল ইসলামিক দলগুলো। নিরপেক্ষভাবে বলছি তাদের কথাগুলো একটু বলা যেত।’

“এই ঘোষণাপত্র যদি ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর জন্মসনদ হয়, তাহলে তাতে সব পক্ষের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা দরকার ছিল। গ্রহণ-বর্জনের রাজনীতি দিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়,” মনে করেন ড. সাব্বির।

তবে রাজনীতি বিশ্লেষক ড. মামুন আল মোস্তফা বলেন, ‘এনসিপি নামে কোনো সংগঠন আন্দোলনে ছিল না। যারা রাজপথে ছিলেন, তাদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, কেউ কেউ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। পরে তাদের একাংশ এনসিপি গঠন করেছেন।’

‘প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তবে গত এক বছরে নারী ও সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত ঘটনা, আর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যেসব উদাহরণ দেখা গেছে—তা এই ঘোষণাপত্রের ভাষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নীতি ও বাস্তব কর্মকাণ্ডের মধ্যে বড় ফারাক রয়েছে’, বলেন ড. মামুন।

অধ্যাপক সাব্বির বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্র নির্মোহভাবে লেখা হয়নি। এতে শেখ হাসিনার শাসনকে ফ্যাসিবাদ বলা হলেও, দেশে ফ্যাসিবাদী চর্চা তার আগেও ছিল, বিশেষত সামরিক শাসনের সময়। ১৯৭৫-৯০ সময়কাল এবং আগের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা যদি স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হতো তাহলে এই ঘোষণাপত্রে নির্মোহতা বজায় থাকত।’

‘তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান একটি বড় ঘটনা, তার স্বীকৃতি দরকার ছিল। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে তা কিছুটা হলেও এসেছে,’ মনে করেন অধ্যাপক সাব্বির।

ঘোষণাপত্রে বিএনপি-এনসিপিকে সন্তুষ্ট করা হয়েছে, দাবি বিশ্লেষকদের

ঘোষণাপত্রের ২৪ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব শহীদকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে প্রয়োজনীয় সব আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘জুলাই বিদ্রোহ ছিল আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য একটি বিশাল সাফল্য। অবশ্য এদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল ভিন্ন ভিন্ন—বাম, মধ্যপন্থী, ডান এবং চরম ডানপন্থী। এই ঘোষণার মাধ্যমে তারা জনগণকে জানিয়ে দিল যে, তারা কেবল আওয়ামী-বিরোধিতার বাইরেও একটি যৌথ রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। এই স্বীকৃতির তাৎপর্য মূলত প্রতীকী।’

‘তবে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয়ভাবেই, এই বিদ্রোহের সুফল তারা উপভোগ করছে—যেমনটা এর আগের আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে নিজেদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক লাভ তুলেছিল।’

‘স্বল্পমেয়াদে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে—এটাই সম্ভবত অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্যের মূল বার্তা ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশ তাদের দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) দেওয়ার চিন্তা করছে, যা তাদের দেশের ভেতর ও বাইরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে। আবার, বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে, দায়মুক্তি খুব একটা টেকে না।’ বলছিলেন অধ্যাপক মামুন।

রাজনীতি বিশ্লেষক সাইমন মহসীন মনে করেন, ‘এই ঘোষণায় প্রাতিষ্ঠানিক বা আইনগত সংস্কারের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নেই। এটি সংস্কারের রূপরেখার চেয়ে বেশি করে একটি আবেগনির্ভর দলিল, যার মূল উদ্দেশ্য জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের জন্য নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।’

তিনি বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান ও এর নেতৃত্বকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার দাবি করা হয়েছে যেন তারা ভবিষ্যতে কোনো আইনি বা সাংবিধানিক তদন্তের আওতার বাইরে থাকেন। এতে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদার সঙ্গেও তুলনা টানা হয়েছে।’

ঘোষণাপত্রে বিএনপি-এনসিপিকে সন্তুষ্ট করা হয়েছে, দাবি বিশ্লেষকদের

‘এছাড়া এতে মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিবরণ রয়েছে’ বলেন সাইমন মহসিন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্রের শেষের দিকে বলেছেন, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।

অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা মনে করেন, এই প্রতিশ্রুতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দিতে পারেন না, তিনি কেবল আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারেন। এই নিশ্চয়তা দিতে পারে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং এদেশের মানুষ।

এই জুলাই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে কিনা জানতে চাইলে ড. মামুন বলেন, ‘রাজনীতি সবার মধ্য দিয়ে করে আনার বিষয়। কোনো একজন মহানায়ক ঘোষণা দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়।’

‘অধ্যাপক ইউনূস যত মহান ব্যক্তিই হন, তার যত ইচ্ছাই থাকুক; রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের আচরণগত পরিবর্তন দরকার। সেটার জন্য কোনো ঘোষণাপত্র দিয়েই সেটি সম্ভব নয়,’ বলে মনে করেন তিনি।