
তাদের আনা হয়েছিল গেস্ট স্কলার হিসেবে। কেউ বুয়েট, কেউ চুয়েট আবার কেউ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কর্তৃপক্ষের ডাকে কেউ আবার এসেছেন কানাডার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কারো হাতে ছিল সম্মানির চুক্তিপত্র, কেউ আবার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এসেছিলেন পাঠদান ও গবেষণার জন্য।
তবে শেষমেশ তাদের কপালে জুটেছে অপমান ও বঞ্চনা। অন্তত ১০ জন শিক্ষক ও গবেষক অভিযোগ করেছেন, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগাং (ইউএসটিসি) কর্তৃপক্ষ সম্মানি আটকে রেখেছে। দীর্ঘদিন কাজ করার পরও কারো বেতন ফেরত নেওয়া হয়েছে। আবার কাউকে অপমান করে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
ওই শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১১ জনের মধ্যে অন্তত ১ জনের বেতন ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। একজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। বাকি ৯ জনকে বঞ্চিত করা হয়েছে বেতন থেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এসব প্রতারণার নেপথ্যে রয়েছেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আহমেদ ইফতেখারুল ইসলাম এবং রেজিস্ট্রার দিলিপ বড়ুয়া। এই দুজন মিলে যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়োগ দেন, বরখাস্ত করেন, অডিট লেখেন, ব্যয় করেন আর শেষে শিক্ষকদের সামনে রেখে তাদেরই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেন। এর মধ্যে দিলিপ বড়ুয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ফলে প্রতারণার শিকার কেউই তখন মুখ খুলতে পারেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইউএসটিসিতে ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ফার্মেসি বিভাগে ১০ বছর শিক্ষকতা করেছেন বর্তমানে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) সহযোগী অধ্যাপক কিশোর মজুমদার। তার ছিল অস্ট্রেলিয়া ও জাপান থেকে নেওয়া ডিগ্রি। যবিপ্রবিতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য ইউএসটিসি থেকে অব্যাহতি চান। এতেই বাধে বিপত্তি।
যবিপ্রবিতে যোগ দেওয়ার পর কিশোর মজুমদারকে ইউএসটিসি চিঠি দিয়ে জানায়, তাকে গত ১০ বছর যেসব বেতন দেওয়া হয়েছে সেগুলো ফেরত দিতে হবে। অন্যথায় যবিপ্রবি কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে এই বিষয় জানানো হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ায় ওই শিক্ষক আর ঝামেলায় জড়াতে চাননি। ওই সময় তিনি প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে কিশোর মজুমদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি অনেক কিছু বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, আপনি যার কাছ থেকে এই ঘটনা জেনেছেন, তার কাছ থেকেই আমার বিষয়টি জেনে নেন।
ওই সময় ইউএসটিসির বোর্ড অব ট্রাস্টির মেম্বার ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফৈয়াজ খান। তিনি আমার দেশকে বলেন, আমি কিশোরের জন্য অনেক ফাইট করেছিলাম। তিনি ১০ বছর সার্ভিস দিয়েছেন। ওই সময় যা সম্মানি পেয়েছেন, সেগুলো তাকে ফেরত দিতে হয়েছে। অনেক শিক্ষকের সঙ্গে এমন করা হয়েছে। আপনি জানেন, শিক্ষকরা সহজেই সবকিছু বলে না। প্রতিবাদও করে না। কিন্তু এখন বলছি, যারা জানে না তারা জানুক। সেখানে সার্ভিস দেওয়ার আগে সবাই যেন সতর্ক থাকে।
১৯ বছর চাকরি করা আখতার জাহান ছিলেন ইউএসটিসির ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন। তাকে হুট করে অফিস চলাকালেই ছাঁটাই করা হয়। তিনি আমার দেশকে বলেন, সকালেও অফিস করেছি। দুপুরে চিঠি দিয়ে বলা হয় আপনাকে আমরা আর রাখতে পারছি না। চিঠি ইস্যু করেছেন রেজিস্ট্রার দিলিপ বড়ুয়া। জুনিয়র ও অশিক্ষিত একজনের সই করা চিঠিতে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো, এর চেয়ে অপমানজনক আর কী হতে পারে।
কানাডা থেকে আসা শিক্ষক পাননি বেতন
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব নোভা স্কোটিয়ার সাবেক অধ্যাপক ড. মাসুদুল আলম চৌধুরী। তিনি বিশ্বখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ এবং ইসলামি ফাইন্যান্সের শীর্ষ গবেষক। এই অধ্যাপককে আধুনিক ইসলামি অর্থনীতির ‘ইবনে খালদুন’ বলা হয়। তার লেখা ‘মানি ইন ইসলাম’ বইটি ইসলামি মুদ্রাব্যবস্থা ও ফাইন্যান্স বিষয়ে আলোচিত গবেষণাগুলোর একটি। তাকে প্রাপ্য বেতন থেকে বঞ্চিত করেছে ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইউএসটিসির এক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় তাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়। নিজ খরচে তিনি আসেন, পাঠদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সেশন ও পরামর্শমূলক বৈঠকেও অংশ নেন তিনি। সবমিলিয়ে ছয় মাসের বেশি সময় তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু কাজ শেষে তাকে বেতন দেওয়া তো দূরের কথা কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি। তিনি এই বিষয়ে লিগ্যাল নোটিসও দিয়েছেন। সেই নোটিসের কোনো উত্তর দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মাসুদুল আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, আমি সেটা পেশাদারভাবে গ্রহণ করি। নিজ খরচে বাংলাদেশে গিয়ে দীর্ঘ সময় পাঠদান করেছি, নীতিগত ও পরামর্শমূলক কাজেও যুক্ত ছিলাম। কিন্তু কাজ শেষে তারা কোনো বেতন দেয়নি, এমনকি কোনো যোগাযোগও রাখেনি। এটা শুধু অপেশাদার আচরণ নয়, আমার ব্যক্তিগত মর্যাদার ওপরও আঘাত। আমি অপমানিত ও প্রতারিত বোধ করছি।
লিগ্যাল নোটিস পাঠানোর বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, আমি তাদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেছি। এরপর আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে লিগ্যাল নোটিস পাঠিয়েছি। কিন্তু এতদিনেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। যে কোনো পেশাদার শিক্ষক বা গবেষকের সঙ্গে এমন আচরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
এরকম বেতন পাননি বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক প্রোভিসি অধ্যাপক আবু নওশাদ চৌধুরী। একইভাবে সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমও তার প্রাপ্য বেতন পাননি। এই বিষয়ে তিনি হাইকোর্টে রিটও করেন।
বুয়েট, চুয়েট ও চবির ছয় শিক্ষকের সঙ্গে প্রতারণা
ইউএসটিসিতে কয়েক বছর চাকরি করার পরও বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন বুয়েট, চুয়েট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষক। তবে, তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকায় নাম প্রকাশ করেননি।
বুয়েটের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ইউএসটিসিতে খণ্ডকালীনভাবে প্রায় দুই বছর পড়িয়েছেন। কিন্তু কাজ করার পরও তাকে কোনো বেতন দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তিনি বহুবার যোগাযোগ করেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই শিক্ষক বলেন, শিক্ষকদের প্রতি কোনো প্রতিষ্ঠানের এমন অবহেলা করা উচিত নয়।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই তরুণ শিক্ষক ইউএসটিসির বিভিন্ন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। একজন কাজ করেছেন প্রায় তিন বছর, অন্যজন দেড় বছর। তাদেরও কোনো বেতন দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে তারা পদত্যাগ করেন। তাদের একজন বলেন, যখনই বেতন চেয়েছি তখন তাদের উত্তর ছিল দিচ্ছি, একটু অপেক্ষা করুন। সেই অপেক্ষা আর শেষ হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক ইউএসটিসিতে খণ্ডকালীনভাবে দুই থেকে চার বছর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন। তাদেরও বঞ্চিত করা হয়েছে বেতন থেকে। তাদের একজন বলেন, প্রথমে মনে করেছিলাম দেরি হচ্ছে, পরে বুঝলাম এটা আসলে পরিকল্পিত।
নাটের গুরু আহমেদ ইফতেখারুল ইসলাম
ইউএসটিসি প্রতিষ্ঠা করেন চিকিৎসা ও শিক্ষাক্ষেত্রে কিংবদন্তি নুরুল ইসলাম। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লাইড হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স, যা পরে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি) নামে পরিচিতি পায়। তিনি ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন তার ছেলে ইফতেখারুল। বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য আছেন ১১ জন। এর মধ্যে রয়েছে তার দুই বোন প্রকৌশলী নুর-ই-জান্নাত আয়েশা ইসলাম দিনা ও ডা. নিনা ইসলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কিছু সূত্র জানায়, ইউএসটিসি এখন মূলত চলে ইফতেখারুলের কথায়। উপাচার্য বা ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও, সেটি বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নির্ধারণ করেন তিনি। এমনকি কেউ বেতন বা সম্মানি পাবেন কি না, সেটিও নির্ভর করে তার অনুমোদনের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার, ওয়ার্কশপ বা প্রশিক্ষণের জন্য খ্যাতিমান স্কলারদের আমন্ত্রণ জানানো হলে তাদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক সম্মানি বা সম্মানজনক ব্যবস্থাপনার বিষয়েও তিনি সিদ্ধান্ত দেন। অনেক স্কলার, এমনকি বিদেশি অধ্যাপককেও বেতন না দিয়ে অপমানজনকভাবে বিদায় দেওয়া হয়েছে, কারণ ইফতেখারুল এভাবেই বিষয়টি চেয়েছেন।
বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কয়েকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইফতেখারুল কোনো নির্বাচিত বা নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা নন। তবে তার কথাই শেষ কথা। কোনো কিছুতেই কারো সাহস হয় না তার মতামতের বিরুদ্ধে কিছু বলার।
বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য ও তার বোন ডা. নিনা ইসলাম আমার দেশকে বলেন, আমার বাবা যখন মারা যান তখন ৫০ কোটি টাকা এফডিআর রেখে যান। এই টাকার হিসাব এখনো আমরা পাইনি। ইফতেখারের সিদ্ধান্তই বড় সিদ্ধান্ত। ট্রাস্টি বোর্ড একটি শো মাত্র। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় অডিট করেছিল। যারা অডিট করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত অনুষ্ঠানে গেস্ট হিসেবে আসত। বাকিটা আপনি বুঝে নেন।
শিক্ষকদের বেতন না দেওয়ার বিষয়ে ডা. নিনা বলেন, অনেক শিক্ষক তার প্রাপ্য সম্মান পাননি, পাচ্ছেন না। অনেকে সার্ভিস দেওয়ার পর অন্যত্রে চলে গেলে কয়েক বছর পর তাদের চিঠি দেওয়া হয়। টাকা দাবি করা হয়। এই বিষয়গুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানে, তবুও তারা চুপ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ইউএসটিসিতে গেলে আহমেদ ইফতেখারুল ইসলাম ও দিলিপ বড়ুয়া— দুজনই যান এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেননি। পরে, মোবাইলে কল দেওয়া হয়। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু দুজনই এই প্রতিবেদকের নম্বর ব্লক করে দেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) সহকারী সচিব মো. শাহ আলম সিরাজ আমার দেশকে বলেন, শিক্ষকদের ডেকে এনে বেতন না দেওয়া এবং বেতন দিয়ে তা ফেরত নেওয়া ভয়াবহ অন্যায়। যারা ভুক্তভোগী বা যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কাজ করে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তারা আমাদের জানালে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।