Image description

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর সরকারের মদদপুষ্ট একদল চিহ্নিত পুলিশ সদস্য নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর মারমুখী অবস্থান নেন। তখন একের পর এক নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শরীরের তাজা রক্ত ঝরিয়ে শুধু খ্যান্ত হয়নি, লাশের ওপরও চালায় নৃশংসতা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও টেনে হিঁচড়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। গত বছরের ৪ আগস্ট এমন বীভৎস চিত্র দেখার মতো ছিল নন, এ যেন রক্তের নৃশংস হোলিখেলা। নির্মমতার সব সীমা অতিক্রম করেন সেদিনের কিছু পুলিশ সদস্য। গুলিতে ও নির্মম-নৃশংসতায় সহস্রধিক নিরীহ মানুষের প্রাণ নেয়ার পর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ওই সময়ের সবচেয়ে সমালোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপি কমিশনার হাবীবুর রহমান, ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম ও অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারসহ অনেক কর্মকর্তা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা পুলিশ সদর দফতর থেকে শুরু করে থানা-ফাঁড়িতে তাণ্ডব চালিয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটায়। থানা ছেড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যান। তখন থানাগুলো ভুতুরে অবস্থায় পরিণ

তবে সেখান থেকে সক্রিও হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। পুড়ে যাওয়া থানা সংস্কার হয়েছে। আনা হয়েছে কিছু গাড়িও। ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়ে মাঠে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের জন্য পুলিশকে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আসলেই পুলিশ কতটুকু প্রস্তুত? কতটুকুই বা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে পুলিশ?

এ বিষয়ে গতকাল পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, শত চেষ্টার পরও পুলিশকে ঘুরে দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। শাহবাগে ৫০-৫৫ জন রাস্তা অবরোধ করে ওই রাস্তা দিয়ে অন্তত ২০ হাজার যাতায়াতকারীদের জিম্মি করে রাখে। পুলিশ নির্বিকার হয়ে শুধু তাকিয়েই দেখেছে। তিনি বলেন, পুলিশ চাইলে টিয়ার শেল, জলকামান ব্যবহার বা লাঠিচার্জ করতে পারত। কিন্তু পুলিশ তা না করে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছে। তিনি বলেন, মানবিক আচরণের নামে পুলিশকে জিম্মি করে জনভোগান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে। সীতাকুণ্ডে মোটরসাইকেল থামানোয় পুলিশের ওপর চড়াও হচ্ছে। এতে কি পুলিশের মনোবল থাকে? যারা বেআইনি কাজ করবে আইনের মাধ্যমে পুলিশকে বল প্রয়োগ করতে দিলে পুলিশের যেমন মনোবল শক্তি পাবে একই সাথে জনসাধারণের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। তিনি বলেন, এখনই পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরেছে এমনটি না বলা গেলেও অনেক উন্নতি হয়েছে।

পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, এই বাহিনীর সদস্যদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণে তাদের মনোবল তলানিতে নেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে এখন একটা জায়গায় পৌঁছেছে। আমি বলব না যে, পুলিশ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু অনেকটাই গোছালো জায়গায় এসেছে। এখন আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করব। নির্বাচনে তো পুলিশ নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে কাজ করে। ফলে সেই দায়িত্ব পালনে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সব ইউনিটকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশ একটা শৃঙ্খলাপূর্ণ বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা চেইন অব কমান্ড মেনে দায়িত্ব পালন করেন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা নয়া দিগন্তকে বলেন, পুলিশ যে জায়গায় পৌঁছেছিল সেখান থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আরো সময় লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি পুলিশকে ব্যবহারের চেষ্টা না করে তাহলে দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আগামী নির্বাচনের আগেই পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালনের একটা জায়গায় পৌঁছবে। সর্বোপরি পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। গত ৪ আগস্ট ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষে শাহজাদা এম আকরাম বলেছেন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় জড়িতদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর জবাবদিহির অগ্রগতি নেই। তিনি বলেন, বিচারের ধীরগতি এবং বিচ্ছিন্ন কিছু বিভাগীয় পদক্ষেপ ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেয়া সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার ঘাটতিকে নির্দেশ করে। সেদিন প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির পক্ষ থেকে শাহজাদা এম আকরাম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার পতনের পর ১১ মাসে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী ও হত্যার নির্দেশদাতা-ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে ২০২৫ সালের ১ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৬০২টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৬৩৮টি হত্যা মামলা। টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এসব মামলার প্রায় ৭০ শতাংশের তদন্তে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে এবং ৬০ থেকে ৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

তবে পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার প্রসঙ্গে টিআইবি জানায়, গত ১১ মাসে সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১টি মামলায় মোট ১ হাজার ১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ৬১ জন। ট্রাইব্যুনালে পুলিশের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রমেও ধীরগতি লক্ষ করা গেছে।