Image description

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধাদের ‘নো ট্রিটমেন্ট-নো রিলিজ’ এর নির্দেশ দিয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। আহতরা যাতে চিকিৎসার অভাবে মারা যায় এ লক্ষ্যে তিনি হাসপাতালের ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দিয়েছিলেন এ নির্দেশ। এমন সাক্ষ্য দিয়েছেন গুরুতর আহত জুলাই যোদ্ধা, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরান (২৫)। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১Ñএ মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে এ জবানবন্দী দেন তিনি। পরে তাকে জেরা করেন আসামি শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত (স্টেট ডিফেন্স) আইনজীবী মো. আমির হোসেন।ইমরান তার সাক্ষ্যে নিজের গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার জন্য ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দায়ী করেন। তাদের শাস্তি দাবি করেন তিনি। মামলার দুই নম্বর সাক্ষী আব্দুল্লাহ আল ইমরান নিজের সাক্ষ্যে বলেন, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (নিটোর) পরিদর্শনে গিয়ে শেখ হাসিনা ‘নো  ট্রিটমেন্ট  নো রিলিজ’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল ইমরান নিজ কানে এই নির্দেশ শুনেছেন। সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় ইমরান গুলিবিদ্ধ হন। ওই গুলিতে তার দুই সহযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ইমরানের বাঁ হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। পুলিশ চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করে। ওই গুলিতে হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত হাঁড়-মাংস উড়ে যায়। পা পাঁকা হয়ে যায়। শুধু চামড়াটুকু ঝুলে ছিলো।

প্রথমে তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু কোনো বেসরকারি হাসপাতাল তাকে চিকিৎসা দিতে সম্মত হয়নি। পরে তাকে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তার তাকে পা কেটে ফেলার পরামর্শ দিলে ইমরানের সতীর্থ-স্বজনরা তাতে সম্মত হননি। সেখান থেকে তাকে শ্যামলীস্থ পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। তখন কারফিউ চলছিলো। ইমরানকে মিটফোর্ড থেকে পঙ্গু হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডিস্থ বাসার সামনে র‌্যাব-বিজিবি অ্যাম্বুলেন্স এক ঘণ্টারও বেশি সময় আটকে রাখে। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা ইমরানকে রক্ত দিতে আসা একজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। এ অবস্থায় বেশ রাতে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ কিংবা ২৭ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আগারগাঁওস্থ পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন শেখ হাসিনা। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা ইমরানের কাছে যান।

হাসিনাকে তিনি ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তাকে ‘আপা’ সম্বোধন করতে বলেন। শেখ হাসিনা তখন ইমরানের কাছ থেকে জানতে চান, ইমরান কোথায় পড়াশুনা করে। হলে থাকেন কি না, কেন থাকেন না-ইত্যাদি বিষয় শেখ হাসিনা জানতে চান। এসব তথ্য জানার পর শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন যে ইমরান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ইমরান বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে? আমি বলি, পুলিশ আমাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে কারা ছিল, সেটা আমি জানি না। আমার পর আরও চার থেকে পাঁচজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে শেখ হাসিনা যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন হেল্পডেস্কের কাছে গিয়ে ‘নো ট্রিটমেন্ট  নো রিলিজ’ অর্ডার দিয়ে যান। যা আমি শুনতে পাই। তবে তখনো আমি এ কথার মানে বুঝিনি। যখন যথা সময়ে আমার অপারেশন হচ্ছিলো না, বাইরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক আমার স্বজনদের আনতে দিচ্ছিলো না, তখন আমি বুঝতে পারি, যথসময়ে চিকিৎসা না দিয়ে পা কেটে আমাকে কারাগারে নিতে চেয়েছিল তারা। এ ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দায়ী করেন ইমরান। এবং এ অপরাধের জন্য তিনি তাদের বিচার ও শাস্তি দাবি করেন। পরে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী (স্টেট ডিফেন্স) মো. আমির হোসেন আব্দুল্লাহ আল ইমরানকে জেরা করেন। জেরায় আমির ইমরানের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি (ইমরান) একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী। পক্ষান্তরে আমার মক্কেল শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল আরেকটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। এ কারণে আপনি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন। জবাবে ইমরান বলেন, ‘ইহা সত্য নহে’।

ইমরানের পর মামলার তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ১৮ জুলাই পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো পারভীন আক্তার (২৭)। সাক্ষ্য প্রদানকালে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় এজলাসে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা পারভীন বলেন, আমার দুই সন্তানের কাছে আমি অন্ধ মা হয়ে  গেছি। আমার এই অন্ধ হওয়ার জন্য একমাত্র  দায়ী শেখ হাসিনা।

তিনি জানান, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে এক চোখ অন্ধ হয়ে যায় তার। থাকতেন যাত্রাবাড়ি কুতুবখালিতে। এখন বসবাস করেন বরিশাল স্বামীর বাড়ি। ঢাকায় থাকা অবস্থায় দিনমজুরের কাজ করতেন পারভীন। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো জুরাইনে ৫টা পর্যন্ত কাজ করে লেগুনা স্ট্যান্ডে আসি। তবে এখানে কোনো গাড়ি না পেয়ে পায়ে হেঁটে রওনা হই। যাত্রাবাড়ী এসে দেখি অনেক মানুষ আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ১৮/১৯ বছরের একটা ছেলেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। ছেলেটি চিৎকার করছিল আর তার সারা শরীর রক্তাক্ত ছিল। এছাড়া তার দুই চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ছেলেটির গলায় একটা আইডি কার্ড ছিল। ছেলেটি শুধু বলে আমাকে বাঁচান। এক পর্যায়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আমাকে ধরে আমার ঘাড়ে মাথা দেয়। আমি রিক্সা খুঁজতে থাকি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।

উল্লেখ্য, চব্বিশের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় (নং-০২/২০২৫) তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ১ জুন পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরুর আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন।