
দেখতে দেখতে ফিরে এলো ক্যালেন্ডারের পাতায় ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ৩৬ জুলাই। আজ থেকে এক বছর আগে ২০২৪ সালের এই দিন মাফিয়া নেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে উঠছেন হাসিনা এবং হেলিকপ্টার আকাশে উড়ছেÑ সে দৃশ্য এখনো মানুষের চোখে ভাসছে। এখনো এক বছর আগের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আন্দোলনের দিনগুলোর কথা মনে পড়লে গা শিউরে উঠে। কী বিভীষিকাময় দৃশ্য। ১৯ জুলাই কারফিউ জারির পর থেকে ১৬টি দিন প্রতিটি রাত রাজধানী ঢাকার মানুষের জন্য ছিল কালরাত্রি। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু লাশ আর রক্তের দৃশ্য। কান পাতলেই শোনা যেত গুলির শব্দ আর মৃত্যুর বিভীষিকা। ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়া কেমন ছিল সে দিনগুলো?
মাফিয়ারানী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগের কয়েক দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে পৈশাচিক হত্যাকা-ে মেতে উঠেছিলেন। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেনÑ ‘পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে রাজনীতিতে এসেছি’। ভারতের নীলনকশায় ১৫ বছর আট মাস ক্ষমতায় থাকার পর পালানোর আগে তিনি জাতির উপর সেই প্রতিশোধ নেন। মেতে উঠেন হত্যাযজ্ঞে। যারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাত দেখেননি; ইতিহাসে পড়েছেন তারাও ২০২৪ সালের ২০ জুলাই থেকে টানা ১৫ দিন কালোরাত্রির মুখোমুখি হয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আন্দোলনের শেষ দিকে ২০ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট প্রতিটি রাত রাজধানী ঢাকার মানুষের জন্য ছিল কালরাত্রি। রাত হলেই নেমে আসতো নিস্তব্ধতা; কখন কাকে হত্যা করা হবে কেউ জানত না। বিশেষ করে যেসব পরিবারের তরুণ-তরুণীরা আন্দোলনে ছিলেন তাদের পরিবারের সদস্যরা সারারাত জেগে থাকতেন কখন তাদের আপনজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। বিভীষিকার ১৫টি কালোরাতের পর এসেছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছে খবর প্রচার হলো। আজ ক্যালেন্ডারের হিসেবে ৫ আগস্ট আর দেশের মানুষের জন্য ৩৬ জুলাই। এক বছর আগে ২০২৪ সালের এদিন গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারহরণকারী ভারতের নাচের পুতুল শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়ার আগে তিনি দেশে ম্যাসাকার করেন।
ভারতের নীলনকথা অনুযায়ী তিনটি জাতীয় নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকেছেন হাসিনা। অতঃপর ক্ষমতা আরো দীর্ঘায়িত করতে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারি সেজে দেশের মেধাবী ও শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করে অনুগতদের চাকরি দেয়ার জন্য কোটা পদ্ধতির নামে দলীয় লোকজনকে প্রশাসনে নিয়োগ দেন। এ কাজে তিনি জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগসহ সবগুলো সেক্টরকে ব্যবহার করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা চেয়েছিল মেধার ভিত্তিতে চাকরির নিশ্চয়তা। সেটি না হওয়ায় দেশে গড়ে উঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন, পৈশাচিক হত্যাকা-, জরুরি অবস্থা জারি, হাসিনার অলিগার্ক আমলা, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের তা-বলীলা ভয়াবহ পর্যায়ে নেন। তারপরও শিক্ষার্থীদের দমানো যায়নি। সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে আন্দোলন ঠেকাতে টাকা খরচ করে। শেখ হাসিনার নির্দেশে র্যাব-পুলিশ-বিজিবি-সেনাবাহিনীসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনীর অস্ত্রবাজি আর হত্যাকা-ে রাজধানী ঢাকার চিত্র হয়ে উঠেছিল ইসরাইলি বাহিনীর গাজা আক্রমণের চিত্রের মতোই। সেসব ভয়াবহ চিত্র তথা ছবিসহ খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে।
মূলত ২০২৪ সালের ১ জুলাই নতুন উদ্যমে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন। আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে ১৬ জুলাই। পুলিশের গুলিতে রংপুরের আবু সাঈদসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়। দাবি আদায়ে বিক্ষোভকারীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করে। ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট কোটায় আমূল সংস্কারের কথা ঘোষণা করে। আন্দোলন আরো তীব্র হয় আগস্টের শুরু থেকে। ৫ আগস্ট উত্তাল পরিস্থিতিতে তীব্র আন্দোলনের মুখে দাঁড়িয়ে পতন হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। কারফিউয়ের মধ্যেই ওই দিন দুপুরে তীব্র জল্পনা শুরু হয় শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছেন। বোন শেখ রেহানা ও দুই ডজন ব্রিফকেস ভর্তি ডলার-পাউন্ড নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। হেলিকপ্টারে হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে দেশের ছাত্র-জনতা ফেটে পড়ে খুশিতে-উচ্ছ্বাসে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে লাখো জনতা প্রবেশ করে হাসিনার ব্যবহৃত সব কিছু তছনছ করে দেয়। এমনকি হাসিনা সেদিন দুপুরের খাওয়ার জন্য যে রান্না করেছিলেন সেগুলো ফেলে গেছেন। সামাজিক মাধ্যমে লেখা হতে থাকেÑ ‘স্বাধীনতার দিন ৩৬ জুলাই’। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ৩৬ জুলাই বলে কোনো দিন-তারিখ নেই। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর কারণে ৩৬ জুলাই হয়ে রইল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিন।
আজ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। তারপরও এখনো বহু মানুষ হাসপাতালের বেড়ে কাতরাচ্ছেন। অনুসন্ধান করে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো অনেকে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ভাঙা হাত-পা নিয়ে অনেকেই সুচিকিৎসা নিচ্ছেন। গুলিতে কয়েকশ ছাত্র-জনতা ও নি¤œআয়ের পেশাজীবী হাত-পা হারিয়েছেন।
মূলত ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই বর্তমানে দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশে আন্দোলন দমন করতে ঢাকার রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, শাহবাগ ও কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মহাখালি, বাড্ডা, মিরপুর, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, গুলিস্তান, চানখাঁরপুল এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে মিছিলকারীদের হত্যা করা হয়। জুলাই-আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় কয়েকশ’ মানুষকে হত্যা করা হয়। ফলে ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর ৬ আগস্ট ছাত্র-জনতা যাত্রাবাড়ী, কদমতলী থানাসহ কয়েকটি থানা ঘেরাও করে। কোনো কোনো থাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়। যাত্রাবাড়ীর পরে রাজধানীতে সবচেয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে বাড্ডা, রামপুরা বিটিভি ভবন ও আফতাবনগর এলাকায়। ওই এলাকায় পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের পাশাপাশি সিনেমা-নাটকের নায়ক-নায়িকারাও ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে মাঠে নেমেছিল। ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাড্ডা, রামপুরা ও আফতাবনগর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (র্যাব-পুলিশ-বিজিবি-আনসার) গুলিতে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান।
মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকা যখন অগ্নিগর্ভ, পথে পথে রক্তের দাগ ও হাসপাতালগুলোতে লাশের সারি, তখন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা হত্যাকা-ের প্রতিবাদে আন্দোলন সমর্থন করে মিছিল বের করে। ৪ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের পক্ষে মহাখালী ডিওএইচএসে রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলন সমর্থন জানানো হয়। প্রতিদিন শত শত লাশ ফেলার পরও হাসিনার রক্তচক্ষু থামেনি। এক সময় শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশ দেন। তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। একদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে।
অন্যদিকে হাসিনার নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মারছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে চানখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শহীদ হন। আহত হন শত শত ছাত্র-জনতা। পুলিশের গুলি করে মানুষ মারার দৃশ্যের একটি চাঞ্চল্যকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
১ জুলাই : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম, রংপুর বেগম রোকেয়া ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে এদিন তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
৭ জুলাই : সারা দেশে নতুন কর্মসূচি ‘বাংলা ব্লকেড’ পালন করা হয়। ব্যাপক বিক্ষোভ-অবরোধে অচল হয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। মারমুখী হয়ে উঠে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি। পরের দিনও ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।
৮ জুলাই : পুলিশের বাধার মুখে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ করে। ছাত্রলীগ, যুবলীগের পা-াদের ঢাকার রাজপথে নামানো হয়। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র টহল বেড়ে যায়।
৯ জুলাই : সারা দেশে সড়ক ও রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সকাল-সন্ধ্যা ব্লকেড-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা বহাল রেখে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে আইনজীবীর মাধ্যমে পক্ষভুক্ত হন দুই শিক্ষার্থী। এ সময় অনেকে ওই দুই শিক্ষার্থীকে সরকারের এজেন্ট হিসেবে প্রচার করা হয়।
১০ জুলাই : কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের আদেশের ওপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা, ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ।
১৪ জুলাই : কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ। ওই দিন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (বর্তমানে ভারতে পলাতক) মন্তব্য ক্ষোভ আরো উসকে দেয়। শিক্ষার্থীদের উপর বিক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা (চাকরি) পাবে? কোটার সমাধান দেবে আদালত, অশান্তি হলে আইন চলবে নিজের গতিতে।’ ওইদিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনাকে ব্যঙ্গ করে মিছিল বের করে। ‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার, রাজাকার’ সেøাগান উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
১৫ জুলাই : ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের উচিত শিক্ষা দেয়ার নির্দেশ দেন। সশস্ত্র ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। নিরীহ ছাত্রীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলার ছবি আর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় সাধারণ মানুষ। দেয়ালে দেয়ালে স্বৈরাচারবিরোধী সেøাগান দিয়ে গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত আহত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা না করতে চিকিৎসকদের উৎসাহিত করেন।
১৬ জুলাই : উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। সড়ক অবরোধ, সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পুলিশ-র্যাব-বিজিবি মারমুখী হয়ে শিক্ষার্থীদের উপর প্রকাশে গুলি চালাতে থাকে। পুলিশের গুলিতে ছয়জন শহীদ হন। শহীদের একজন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ প্রাণ হারান পুলিশের গুলিতে। দুই হাত প্রসারিত করে রাখা আবু সাঈদকে গুলি করার ঘটনা ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সচিত্র খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়। দেশ-বিদেশের মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। উত্তাল হয়ে উঠে পুরো দেশ। সরকার বাধ্য হয়ে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধের ঘোষণা করে। শিক্ষার্থীরা ‘হয় হাসিনার পতন নয় তো মৃত্যু’ সেøাগান দিয়ে মাঠে নামে। দেশের সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে মেনে আসে। রাতেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের পিটিয়ে বের করে দিয়ে কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। ১৫ বছর ধরে ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা ছাত্রলীগ এক রাতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
১৭ জুলাই : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা করতে বাধা দেয় পুলিশ। ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের হাজার হাজার লাঠিয়াল বাহিনী রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। পুলিশ গায়েবানা জানাজায় বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এদিন বিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। লাখো শিক্ষার্থী রাজপথে নেমে আসে। সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী; উচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা রাজপথে অবস্থান নেয়। পুলিশ ঘরে ঘুরে তল্লাশি করে গণগ্রেফতার শুরু করলে সোশ্যাল মিডিয়ায় সে খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় মারমুখী হয়ে উঠে পুলিশ ও বিজিবি। ছাত্র-পুলিশের মধ্যে সঙ্ঘাতের সূত্রপাত হয়। সঙ্ঘাত যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া, রায়ের বাগ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে; নিহত হন এক সাংবাদিকসহ কয়েকজন। যাত্রাবাড়ীর কাজলায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ওই রাতেই ফেসবুক বন্ধ করে আন্দোলন ঠেকানোর কৌশল নেয়া হয়। সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ হলেও মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
১৮ জুলাই : ছাত্র আন্দোলনে সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন পেশাজীবী অংশগ্রহণ করে। এতে সহিংসতা অব্যাহত থাকে। ঢাকার মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, পরে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়। বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। মহাখালির সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক গুলিবর্ষণ করলে শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন শহীদ হন। ৫৬ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ কোটার প্রস্তাব দেয় আওয়ামী লীগ। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী। পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীদের হত্যাকা-ের প্রতিবাদে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাত ৯টা থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।
১৯ জুলাই : ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, পরিস্থিতি থমথমে হয়ে উঠে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় সর্বক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিলেও বিএনপির কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী নামানো হয় এবং রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি হয়। সারা দেশে সংঘর্ষ এবং পুলিশ-র্যাব-বিজিবির গুলিতে অন্তত ৫৬ জন নিহত হন। কারফিউ জারির খবরে ছাত্র-জনতা আরো মারমুখী হয়ে উঠে এবং প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া’, দুই মন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি দিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসারত কয়েকজন ছাত্রনেতাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য করা হয়। সেখানে আট দফা দাবি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম। বৈঠকের ফলাফল ফলাও করে গণমাধ্যমে লাইভ প্রচার করা হয়।
২০ জুলাই : কারফিউ ভেঙে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিক-মুটে-মজুর-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শিক্ষক সমাজসহ সবস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সঙ্ঘাত চলে। পুলিশের গুলিতে বহু বিক্ষোভকারী হতাহত হন। গুলিবিদ্ধ হন শত শত আন্দোলনকারী। এদিন ফের আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সাথে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়কারীর সঙ্গে বৈঠক করেন। আন্দোলনকারীরা আট দফা দাবি পেশ করেন। ওই বৈঠক নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে মতভেদের খবর সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। সহিংসতা ও পুলিশের গুলিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অন্তত ২৬ জন শহীদ হন।
২১ জুলাই: আপিল বিভাগের শুনানির পর কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়। সরকারি চাকরিতে মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ ও তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ কোটা করার আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। তবে সরকার চাইলে বদলানোর সুযোগ রাখা হয়। রায়ের পরও পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় কারফিউ অব্যাহত থাকে। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ফলে স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানা বন্ধ রাখা হয়।
২২ জুলাই : কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম (বর্তমানে এনসিপির আহবায়ক)। এই সময়ের মধ্যে তারা চার দফা দাবির বাস্তবায়ন দেখার জন্য সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়। বাধ্য হয়ে সরকার সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ায় একং কারফিউও বাড়ানো হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় চার দিনে (১৯, ২০, ২১, ২২ ) অন্তত ১৩১ জনের নিহত হওয়ার খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। হাজার হাজার আহত এবং পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের খবর গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়।
২৩ জুলাই: আন্দোলন অব্যাহত থাকলেও ব্যবসায়ীদের চাপে রাতে অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা ফেরে। পরদিন রাতে সারা দেশে বাসাবাড়িতেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা সচল করে দিতে বাধ্য হয়। মূলত এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যার গোপন নির্দেশনা দেয়া হয়। বেপরোয়া হয়ে উঠে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
২৪ জুলাই : নির্বাহী আদেশে তিনদিন সাধারণ ছুটির পর অফিস খোলে। কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানোয় বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অফিস কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দেয়া হলেও কর্মচারীরা অফিসে যেতে পারেনি।
২৬ জুলাই: আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যান শেখ হাসিনা। মেট্রোরেল স্টেশন, বিটিভি ভবনে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তার কান্না মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। পুলিশের গুলিতে শত শত মানুষের হতাহত হওয়া নিয়ে দুঃখ প্রকাশ না করে শেখ হাসিনা মেট্রোরেল স্টেশনের সিড়ি ধরে কাঁদেন, তার এই ভূমিকাকে ‘নাটক’ আখ্যা দেন সাধারণ মানুষ। কান্নারত শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে বানানো থিম ছড়িয়ে পড়ে, যার ক্যাপশন ছিলÑ ‘নাটক কম করো পিও’। এ সময় ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হয়ে উঠেন হাসিনা। তিনি মাফিয়ার মতোই ছাত্র-জনতার উপর হামলে পড়ার কঠোর নির্দেশনা দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে গ্রেফতার করে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের উপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল দাবি করেন, নিরাপত্তার জন্য হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
২৭ জুলাই : প্রধানমন্ত্রী আহতদের দেখতে না গিয়ে মেট্রোরেল ধরে কেঁদেছেন এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল করা হয়। নেটিজেনরা নানাভাবে হাসিনার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং প্রবাসীরা হাসিনার শাসনক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত রেমিট্রান্স না পাঠানোর জন্য বিশ্বের দেশে দেশে ক্যাম্পেইন শুরু করে। বাধ্য হয়েই প্রধানমন্ত্রী পুলিশের গুলিতে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান। বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করতে এই ধ্বংসযজ্ঞ। এ সময় হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে চিকিৎসকদের তিনি আহতদের চিকিৎসা না করার জন্য গোপনে নির্দেশনা দেন। কারফিউয়ের মধ্যে প্রতিদিন লাশের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। তবে হাসিনা ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেন।
২৮ জুলাই : কোটা সংস্কার আন্দোলনে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদসহ নিহতদের একটি অংশের পরিবারের সদস্যদের গণভবনে নিয়ে আসেন শেখ হাসিনা। পরে জানা যায়, চাপের মুখে তাদের গণভবনে নিয়ে আসা হয়। আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালেও যান হাসিনা। এরই মধ্যে কয়েকশ’ মারা গেলেও আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ১৪৭ মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রচ- চাপের মুখে ১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা হয়।
২৯ জুলাই : শেখ হাসিনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠক ডাকেন গণভবনে। ওই বৈঠকে হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাবনা করলে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে ঐকমত্য হয় ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে। সেখানে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলছে; র্যাব-বিজিবি-পুলিশের গুলিতে প্রতিদিন ঝরে যাচ্ছে প্রাণ।
৩০ জুলাই : কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে সারা দেশে শোক পালন করা হয়। সেই কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার এবং চোখে কালো কাপড় বেঁধে ছবি পোস্ট করার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। লাখ লাখ নেটিজেন তাদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেন। সেনাবাহিনীর সাবেক একাধিক প্রধানসহ সাবেক সেনাসদস্যরাও প্রোফাইল লাল করে পোস্ট দেন।
৩১ জুলাই : ততদিনে ঢাকার রাজপথ ফিলিস্তিনের গাজা নগরীর মতো শাসকদের গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। চতুর্দিক থেকে আসতে শুরু করে হত্যাকা-ের খবর। ¯œাইপার দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা, হেলিকপ্টারে মানুষ হত্যায় মেতে উঠেন মাফিয়া রানী হাসিনা। প্রতিদিন শত শত হত্যাকা-ের প্রতিবাদ এবং আন্দোলনে হত্যার বিচার দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সঙ্ঘাত হয়। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ঘিরে ধস্তাধস্তি হয়। যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া, বাড্ডা, মিরপুর, উত্তরাসহ রাজধানীর কয়েকটি স্পটে ব্যাপক হত্যাকা- ঘটায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
১ অগাস্ট : ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি দেয়া হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে। এর আগে তাদের বন্দুকের নলের মুখে সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলন তুলে নেয়ার লিখিত বিবৃতি পাঠ করানো হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতা আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং নিহতদের স্মরণে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ শিরোনামে কর্মসূচি পালন করা হয়। এর মধ্যেও ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়াণগঞ্জ ও বরিশালে পুলিশের গুলিতে অসংখ্য ছাত্র-জনতা নিহত হয়। গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের সিদ্ধান অনুযায়ী ওই দিন ‘সন্ত্রাসী কর্মকা-ের’ অভিযোগ এনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির এবং সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
২ অগাস্ট : গণমিছিলে হামলা সংঘর্ষ হয়, পুলিশসহ দুজন নিহতের খবর পাওয়া যায়। রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশ হয়ে উঠে যুদ্ধক্ষেত্র। কারফিউয়ের মধ্যেই প্রতিদিন সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এবং হেলিকপ্টার-¯œাইপার দিয়ে হত্যাকা- চলে। শাহবাগে ব্যাপক জমায়েতের মধ্যে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
৩ অগাস্ট : সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন। সে খবর গণমাধ্যমে প্রচার হয়। খবরে প্রকাশ বাহিনীর অধিকাংশ কর্মকর্তা জনতার উপর গুলি চালানোর বিপক্ষে মত দেন। বাধ্য হয়েই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা। সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনকারীরা। শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেয় ভাইয়ের রক্ত মারিয়ে কোনো আলোচনা নয়। ছাত্ররা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল জমায়েত থেকে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা দেয়। এদিন অন্যান্য দিনের তুলনায় রাজধানী ঢাকার পরিবেশ কিছুটা গুমোট-শান্তিপূর্ণ থাকলেও অন্তত ১১ জেলায় হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়তেই থাকে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে। এর আগে পুলিশের দুজন সদস্যকে (যারা ঘর থেকে বের করে আন্দোলনকারীদের প্রকাশে হত্যা করেন) পিটিয়ে হত্যা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের ওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এদিন আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করব। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর ‘অরাজনৈতিক নেই’। হামলা হলে আত্মরক্ষায় তার ‘জবাব’ পুলিশ দেবে। এদিনে মিরপুরে পুলিশের গুলির হাত থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রক্ষা করছেন এমন সচিত্র ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। এদিন মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির তারিখ একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়।
৪ অগাস্ট : অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে মাঠে নামার ঘোষণা দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সারা দেশে ব্যাপক সঙ্ঘাত আর পুলিশের গুলিতে কয়েক শ’ ছাত্র-জনতার মৃত্যু ঘটে। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ১৯ নেতাকর্মী ছিলেন। এদিন পরদিনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ঢাকা মহানগরীতে প্রবেশ করতে থাকেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অস্বীকার করায় আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রী-এমপিরা পালাতে শুরু করেন।
৫ আগস্ট : হাসিনার পালানোর আগের দিনও চোটপাট দেখিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে সেদিন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকামুখী হন লাখ লাখ ছাত্র-জনতা। সকাল ১০টার পর থেকেই চতুর্দিক থেকে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করে লাখো ছাত্র-জনতা। অথচ ফ্যাসিস্ট দলটির নিচের পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ঘূণাক্ষরেও ধারণা করতে পারেনি যে, তাদের পতন আসন্ন এবং হাসিনা পালিয়ে ভারতে যাবে। ৫ আগস্ট সকালেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে পুলিশের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা ও গুলি চালায়। পুরান ঢাকার চাঁনখারপুলে ফিল্মি স্টাইলে কয়েকজনকে হত্যা করে পুলিশ। দুপুরের আগেই হাসিনার পতনের কথা বাতাসে ভাসতে থাকে। পদত্যাগ করে সামরিক উড়োজাহাজে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। প্রচার করা হয়Ñ সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। দু’দফায় ভাষণের সময় পেছানোর পর বিকেলে গণমাধ্যমে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি জানান, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে চলে গেছেন এবং পরবর্তী করণীয় চূড়ান্ত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে। ঢাকার পথে পথে শুরু হয় আনন্দ মিছিল। জনতা গণভবনের দখল নেয়, সেখানে যে যা পেয়েছেন তা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাখার জন্য নিয়ে গেছে। এদিন পুলিশ যেসব এলাকায় ব্যাপকভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, সেসব থানায় হামলা হয়। আওয়ামী লীগ কার্যালয় এবং বহু নেতার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। পথে পথে মানুষের উচ্ছ্বাস, আনন্দ মিছিল ছিল ঢাকাজুড়ে। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। পরে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণে জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত দ্রুত সম্ভব গঠন করা হবে। শিক্ষার্থীরা অঙ্গীকার করেছিল, জুলাই মাসেই শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করবেন। ফলে ৩১ জুলাইয়ের পর ক্যালেন্ডারের পাতায় পহেলা আগস্ট হলেও তারা ৩২ জুলাই তারিখ গণনা শুরু করে; সেই হিসাবে ৫ আগস্ট ছিল তাদের হিসাবে ‘৩৬ জুলাই’। হাসিনা পালানোর তিন দিন পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কাহিনী অন্য ইতিহাস।