
ঐতিহাসিক দিন ৫ আগস্ট আজ। শেখ হাসিনা পালানোর এক বছর। ২০২৪ সালের এই দিনে দিল্লির নাচের পুতুল ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার মাফিয়াতন্ত্র শাসনের অবসান ঘটে। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান তিনি। হাসিনা পালানোর এই এক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনযন্ত্র কী হাসিনামুক্ত হয়েছে? যারা রক্ত দিয়ে দিল্লির দাসী হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করেছে তারা কি জনগণের প্রত্যাশা পুরণের ব্রতী হয়েছেন? ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে মানুষের ভোটের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠা হয়েছে? নাকি আগামী সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে দিল্লির এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে? সাড়ে ১৫ বছর জুলুম-নির্যাতন-গুম-খুন এবং রাজনীতির মাফিয়াতন্ত্রের রানী হাসিনার বিদায়ে দেশের মানুষ খুশি। মানুষের প্রত্যাশা ছিল ভোটের অধিকার সুনিশ্চিত, আইনের শাসন, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার, শিক্ষিক বেকারদের কর্মসংস্থান, মতপ্রকাশ ও নির্বিঘেœ চলাফেরার স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসন অবসানের এক বছর হওয়ায় মানুষ সে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসেব মেলাতে শুরু করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে সে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি কী মিলছে? অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডাররা জনপ্রত্যাশা পুরণের চেস্টারত। নাকি প্রশাসনে আওয়ামী লীগ অনুগত আমলাদের ক্যারিকেচা আর এনজিওকর্মী, বিদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা উপদেষ্টা ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসা ব্যাক্তিদের ক্ষমতায় দীর্ঘমেয়াদে থাকার বাসনায় ভোটের অধিকার অথৈই পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং জনগণ প্রতিহিংসার বলী হচ্ছেন!
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলন ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ঘটে। এক মাসে আন্দোলন সফল হলেও নেপথ্যে ছিল দীর্ঘ ১৮ বছরের জুলুম-নির্যাতন, গুন-খুন-হত্যা, বঞ্চনা, ভোটের অধিকার হারানোর পুঁঞ্জিভুত ক্ষোভ। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কোটি কোটি ছাত্রজনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, প্রায় দেড় হাজার ছাত্রজনতা প্রাণ দিয়েছে। আহত হয়েছে হাজারে হাজার মানুষ। আন্দোলনে আইন শৃংখলা বাহিনীর গুলিতে চোখ হারিয়েছে, পা হারিয়েছে, হাত হারিয়েছে এমন পঙ্গু মানুষের সংখ্যাও কয়েক হাজার। হাজারো রক্তের বিনিময়ে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রী-এমপিরা পালিয়ে গেলেও প্রশাসনে তার অলিগার্ক আমলার মধ্যে কম সংখ্যই পালিয়েছে।
প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এমন ‘হাসিনার কসাই’ খ্যাত বিতর্কিত কর্মকর্তারা পালিয়েছেন বটে; কিন্তু তাদের অনুসারীরা এখনো বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। সিভিল প্রশাসনেও একই চিত্র। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আওয়ামী লীগের অলিগার্ক আমলাদের চাকরিচ্যুতি নিয়ে হৈচৈ হয়েছে বিস্তর; তালিকার পর তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ আমলা এখনো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদেই দায়িত্ব পালন করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে হাসিনার এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিয়োগকৃত আমলা পরিবর্তিত ড. ইউনূসের আমলে মুজিব কোর্ট খুলে গেটাপ পাল্টালেও ‘চেতনায়’ পরিবর্তন আনেননি। মাফিয়ানেত্রী হাসিনার পছন্দের সচিব-ডিসি-এসপি দিয়ে আওয়ামী লীগমুক্ত প্রশাসন গড়া কি সম্ভব? আবার ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে যারা অংশ নিয়েছেন, যাদের পরিবারের সদস্যরা রাজপথে জীবন দিয়েছে, রক্ত ঝড়িয়েছেন তাদের প্রত্যাশা হাসিনার আশির্বাদপুষ্ট আমলামুক্ত প্রশাসন এবং ভোটের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠা। কিন্তু যারা সেটা বাস্তবায়ন করবেন সেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত উপদেষ্টা ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যাক্তিদের কতজন ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করেন? পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধরা দিয়ে ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব না দেয়ায় ’৭২ সালে দেশে ফিরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান যেমন মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানোর বেদনার মর্মবাণী বুঝতে ব্যর্থ হন; দেশ শাসনের নামে অপশাসন করেন; তেমনি বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকারের বেশির ভাগ আমলা ও বিভিন্ন পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বেশির ভাগই ছিলেন বিদেশে। মিডিয়ায় রক্তাক্ত বাংলাদেশের খবর পড়লেও নিজেরা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হননি।
আবার কয়েকজন উপদেষ্টা পদ পেয়েছেন কার্যত ইন্দো-মার্কিন শক্তির কোটায়। পশ্চিমা দেশ থেকে টাকা এনে ‘বাংলাদেশের ‘গরিবী হটাও’ এর নামে ব্যাক্তিগত বিত্তবৈভব গড়ে তোলা এনজিও কর্মকর্তারা আইন, মানবাধিকার, নারী অধিকার, পরিবেশ ইত্যাদি রক্ষায় কথাবার্তা বললেও জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ফলে তারা অন্তর্বর্তী সরকারে দায়িত্ব গ্রহণ করে ছাত্রজনতার চেতনা অনুযায়ী প্রশাসন থেকে আওয়ামী লীগের দলবাজ আমলাদের সরানোর প্রতি উৎস্বাহী হচ্ছেন না। মাঝে মাঝে চাপে পড়ে কিছু কর্মকর্তাকে অবসর, বদলি, প্রমোশন স্থগিত করলেও নিজেদের চেতনার ব্যাক্তিদের প্রশাসনে নিচ্ছেন। ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার মতো জামায়াতের চেতনাধারী আমলাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বের হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ দু’টি মন্ত্রণালয় জামায়াত গ্রাস করেছে। ফলে জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী বিদেশী বিনিয়োগ এনে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জনগণের ভোটের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠা, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, আইন শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এগুলো এগোচ্ছে না। বরং দীর্ঘ এক বছর সংস্কারের অজুহাতে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। হাসিনার অনুগত আমলারা এখনো প্রশাসনের পরতে পরতে অবস্থান করায় বিগত ১৫ বছর ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তিগুলো বাতিল হয়নি। এমনকি ওই চুক্তিগুলো জনসন্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশাসনে সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রায় সাড়ে ১০ লাখ ‘সুবিধাভোগী’ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশাসনে নিয়োগ-পদোন্নতি দেন। এদের বেশির ভাগই এখনো বহাল তবিয়তে প্রশাসনে রয়ে গেছে। ফলে বাঁদর নাচে খুঁজির জোরে’ প্রবাদের মতোই দিল্লি থেকে হাসিনা দেশে ফেরার হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথ্যানুসারে, গত ১৫ বছরে বিসিএসসহ প্রায় সব সরকারি নিয়োগ দলীয় বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। তবে এমন কিছু লোক ঢুকে পড়ে যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলেও নানা কায়দা-কানুন করে চাকরিতে ঢুকেছে। কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে সুযোগ পেয়েছে। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে আওয়ামী লীগ ব্যতীত ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের লোকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস ও নন-ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের আগে তিন স্তরে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই হতো। নিয়োগের পূর্বে দুটি সংস্থাকে দিয়ে প্রার্থীর তথ্য যাচাই করা হতো। এরপরও সন্দেহ হলে জেলা প্রশাসন পুনরায় তদন্ত করত। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করলেও যদি কোনো প্রার্থীর বা তার পরিবারের বিএনপি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে নিয়োগ দেওয়া হতো না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসনের আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা নানা কৌশলে প্রশাসনকে গতিহীন করে রেখেছেন।
একটি গবেষণা অনুসারে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ইউনুস সরকার প্রশাসনে প্রত্যাশিত সত্তুর শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। ডিসির পদায়ন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা, রাজস্ব আদায়, পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমলাতান্ত্রিক গ্যাঁড়াকলে। উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন স্বীকার করে বলেছন, ‘আমলারা সরকারকে অসহযোগিতা করছে’। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরও প্রশাসনের আওয়ামী মদদপুষ্ট রাঘব-বোয়ালদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতাদের প্রশাসনকে আওয়ামী লীগের দোসরদের খপ্পর থেকে মুক্ত করার দাবি অধরাই রয়ে গেছে। অন্যদিকে যারা বিদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে উপদেষ্টা পদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন; তারা এখন সংস্কার কমিশন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইত্যাদির মাধ্যমে নির্বাচন আটকে রেখেছেন। কোনো কোনো উপদেষ্টা অবশ্য ‘জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে ৫ বছর চায়’ এমন প্রচারণা চালিয়ে সংস্কারের অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টায় ব্রতী হন। এখন এরাই ‘বগলে ইট মুখে শেখ ফরিদ’ প্রবাদে মতো মুখে ভারত বিরোধিতা করলেও ভিতরে ভিতরে আওয়ামী লীগকে আগামী সংসদে পুনর্বাসনে দিল্লির এজেন্ডা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির (পিআর) নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হতে কিছু রাজনৈতিক দলকে উষ্কে দিচ্ছেন। ফলে জনগণ যে ভোটের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জুলাই অভ্যুত্থানে রাস্তায় নামিয়েছিল; সে অধিকার এখনো অধরা রয়ে গেছে। অথচ ১৯৯১ সালের বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার, ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের মধ্যে জাতিকে নির্বাচন উপহার দিয়েছে। স্বল্প সংখ্যাক উপদেষ্টা নিয়ে তারা প্রশাসনকে গতিশীল করেছিলেন এবং নির্বাচনের ব্যবস্থাও করেছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এক বছর পার করলেও নির্বাচনের ট্রেন লাইনে তুলতে পারেনি।
অন্তর্বর্তী সরকার এক বছরেও জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু যাদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটেছে সেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া তরুণ নেতারা কী জনপ্রত্যাশা পুরণের পথে রয়েছেন? আগামীতে নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদের ফ্যাসিস্ট আচরণ থেকে বিরত রাখা, ঘুষ-দুর্নীতি থেকে বিরত রাখতে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করার শক্তি অর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন? নাকি নিজেরাও ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন? ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া সূর্য সন্তানদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মব জাস্টিসের অভিযোগ উঠছে কেন?
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারত আক্রমণ এবং যুদ্ধে ঝিলাম নদীর তীরে রাজা পুরুকে (পরাস) পরাজিত করে বন্দী পুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কেমন আচরণ দেখতে চান? পুরু উত্তর দিয়েছিলেন ‘আমি একজন রাজার মতো’ আচরণ চাই। রাজনীতিতে এটাই হওয়া উচিত। অথচ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার চললেও পরাজিত শক্তির উপর মব জাস্টিস হয়েছে।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্ররা ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেন। তাদের বিরুদ্ধে উঠে মব জাস্টিসের অভিযোগ। আফ্রিকার দেশগুলোতে আইনের শাসন না থাকায় মব জাস্টিস হয়। বাংলাদেশে কেন মব জাস্টিস? অথচ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন কায়েম করেছে। দীর্ঘ ১৫ বছর দেশের বিচার ব্যবস্থায় দলবাজি হলেও বর্তমানে বিচার ব্যবস্থা চলছে স্বাভাবিক গতিতে। অথচ পরাজিত শক্তির লোকজনকে ‘মব জাস্টিস’ (উচ্ছৃংখল জনতার বিচার) করে ভারত ও পশ্চিমা শক্তিকে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদ উত্থান’ অপপ্রচারের আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। যে চেতনা নিয়ে শিক্ষার্থীরা জুলাই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে সে চেতনা থেকে ক্রমান্বয়ে কী সরে যাচ্ছে? প্রশ্নটা সংগত কারণে উঠেছে।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীরা গত ফেব্রুয়ারি মাসে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দবস্ত’ ঘোষণা দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করে। পুরনো দলগুলোর মতোই জনগণের অধিকার আদায়ের বদলে নিজেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচলিত রাজনীতির চর্চায় মেতে উঠে। শুধু তাই নয় অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজী, দখল বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায়, বিশেষ করে পরাজিত শক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যাক্তিদের কাছ থেকে চাঁদাবাজী ও ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশ হলে অভিযুক্ত ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার চেয়ে অস্বীকারের পুরনো সংস্কৃতি চর্চায় মেতে ওঠে। অথচ হাসিনার মতো জগদ্বল পাথরকে জাতির ঘাড় ছুঁড়ে ফেলায় জাতির সূর্যসন্তানদের কাজে জাতির প্রত্যাশা ছিল তারা মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির মতোই আচরণ করবেন। কারণ ১৫ বছর আন্দোলন করে দিল্লির কৃতদাস শেখ হাসিনাকে কেউ সরাতে পারেনি। বছরের পর বছর ধরে একজন নারী ১৮ কোটি মানুষকে ‘ঘোল খাইয়ে’ ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে নির্বাচিত সরকার পরিচিত দিয়েছেন। ধুরন্ধর হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করায় শিক্ষার্থীদের কাছে জাতির প্রত্যাশার পারদ উপরে উঠতে থাকে। কিন্তু তারা মব জাস্টিস, চাঁদাবাজী, শত্রু পক্ষ্যকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের মেতে উঠেন। প্রায় ৮শ থেকে সাড়ে ৮শ বছর আগে আবু নাসির সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব ছিলেন মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশের শাসক। শুধু মাত্র মানুষের মধ্যে ফিৎনা ছড়ানোর অপরাধে ইসলামি খেলাফতের প্রচারক তিন হাজার আলেমকে হত্যা করেছিলেন। অথচ হাসিনার মতো মাফিয়ানেত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইতিহাস সৃষ্টির নায়করা জনপ্রত্যাশা পুরণে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপর প্রেসার সৃষ্টির বদলে নিজেরাই আগামীতে ক্ষমতার লোঝে মদমত্ত হয়ে উঠছেন। এটা করতে গিয়ে তাদের কেউ মব জাস্টিস কেউ পরাজিত শক্তির কর্মী-সমর্থকদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা নিচ্ছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতেগোনা কিছু শিক্ষার্থী এনসিপি গঠন করেছেন। নতুন দল থেকে গত ৩ আগস্ট আগামীর বাংলাদেশের বির্নিমানে ২৪ দফা ইসতেহার ঘোষণা করেছে। এ দফাগুলোতে নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক শব্দগুলো ছাড়া নতুনত্ব এমন কিছু নেই যা বর্তমান সংবিধানে নেই। জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচারের সব কথাই সংবিধানে রয়েছে; সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সেগুলো বাস্তবায়নে স্টেক হোল্ডারদের উপর চাপ সৃষ্টি করাই ছিল জনপ্রত্যাশা। কিন্তু উপেক্ষিতই রয়ে গেছে জনপ্রত্যাশা।