Image description
‘হাসিনার পতন না হলে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল’। জুলাইযোদ্ধা সামিন ইয়াসার আভাসের এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক ভয়, শঙ্কা আর বেঁচে যাওয়ার শুকরিয়া। সেই সঙ্গে তার ওই কথায় পরিষ্কার হয়ে ওঠে ২০২৪ সালের ‘জুলাই বিপ্লব’-এর রক্তাক্ত বাস্তবতা, বেদনার ইতিহাস এবং অনড় সাহসের প্রতিচ্ছবি। বগুড়ায় সেই আন্দোলনের দিনগুলোতে যারা রাজপথে ছিলেন, তাদের অনেকেই আজ পা হারানো, চোখ হারানো কিংবা স্থায়ী শারীরিক ক্ষত নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। কারও চোখে এখনো রাবার ব্যান্ডের মতো গুলি আটকে আছে, কেউবা সংসার চালাতে পারছেন না পা হারিয়ে। তাদের অভিজ্ঞতা কেবল ব্যক্তি নয়, বরং একটি প্রজন্মের প্রতিরোধের দলিল। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেইসব যোদ্ধার কণ্ঠে বলা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা- যেখানে আছে গুলির শব্দ, পুলিশের লাঠি, ছাত্রলীগের হামলা, হাসপাতালের ভয়, আর আছে একটি নতুন ভোরের আশাও।

পায়ের বদলে প্রতিজ্ঞা: জুলাইযোদ্ধা রতন ভালো নেই 
গত জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে পা হারিয়েছেন সারিয়াকান্দির শফিকুল ইসলাম রতন। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, দুই মেয়েকে নিয়ে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির পা হারানোয় থমকে গেছে তার পরিবারের উপার্জন। তিনি সারিয়াকান্দি পৌর এলাকার ধাপ গ্রামের মৃত ইলিয়াস উদ্দিন আকন্দের ছেলে। গত তিনবার যমুনা গর্ভে জমিজমা, ভিটেমাটি হারিয়ে গাজীপুরে গিয়ে অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন।

১৬ই জুলাই সকালে শহীদ আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর সারা দেশে যখন আন্দোলন বেগবান হয়, ঠিক সেদিন বিকালে মিছিলে যোগ দেন রতন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে গাজীপুরের শফিপুর এলাকায় যখন মিছিল বের করা হয় তখন পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়। সে দিন পুলিশের গুলি মাথায় লেগে একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এরপর পুলিশের গুলি থেকে বাঁচতে সবার সঙ্গে অটোচালক শফিকুল ইসলাম রতনও দিগ্বি?দিক দৌড় দেন। পুলিশ পিছন থেকে গুলি করে। ফলে একটি গুলি রতনের ডান পায়ে বিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পা নিয়ে দৌড়ানোর ফলে রাস্তার পাশে থাকা একটি লোহার এঙ্গেলও তার ডান হাতে ঢুকে যায়। তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয়। অনেক চিকিৎসার পর শেষপর্যন্ত তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়। জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যান জুলাইযোদ্ধা রতন। এরপর ঢাকায় ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় তিনি একটি কৃত্রিম পা পেয়েছেন। তার বড় মেয়ে সুস্মিতা আক্তার বগুড়া সৈয়দ আহম্মেদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মনোবিজ্ঞান বিষয়ের অনার্স ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। তার ছোট মেয়ে মরিয়ম আক্তার সারিয়াকান্দি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি পা হারিয়ে এখন দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তারা। নিজের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে তিনি তার বড় মেয়ের সুস্মিতার জন্য সরকারের কাছে একটি চাকরি দাবি করেছেন। দেশের মানুষ ভালো থাকলেই পা হারানো সার্থক হবে বলে রতন মনে করেন।

জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পুলিশ পেটাতে থাকে: আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জ ও ছররা গুলিতে আহত হয়েছিলেন বগুড়া শহরের চকফরিদ কলোনি এলাকার সামিন ইয়াসার আভাস। 

আভাস বলছিলেন, জুলাই আন্দোলনে গিয়ে তিনি দুইদিন আহত হয়েছেন। প্রথমবার আহত হয়েছেন ১৬ই জুলাই। সেদিনই বগুড়ায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে উত্তপ্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দুপুর নাগাদ কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় শহরের সাতমাথা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

তিনি দুপুর পর্যন্ত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে আন্দোলন করছিলেন। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় তিনি সাতমাথায় চলা আন্দোলনে যোগ দেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও গুলি ছুড়তে শুরু করে। 

নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে তিনি বগুড়া জিলা স্কুলের সামনে আশ্রয় নেন। ওই সময়ই নাকি পুলিশ তার দিকে সরাসরি গুলি তাক করে তাকে জিলা স্কুলের ভেতরে ঢুকতে বলে। স্কুলে ঢোকার পর এরপর একজন, দুইজন করে প্রায় ৭-৮ জন পুলিশ তাকে মারতে থাকে। লাথি, চড় এবং লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করতে থাকে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পুলিশ তাকে পেটায়। 

এরপর ২রা আগস্ট কলোনি এলাকায় দুপুর দেড়টা নাগাদ ছররা গুলির শিকার হন আভাস। তার হাতে ৬-৭টি ছররা বুলেট বিঁধে যায়। ঘটনার বিস্তারিত জানাতে গিয়ে আভাস উল্লেখ করেন, তারা একদল শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় লোকজন কলোনি এলাকায় আন্দোলন করছিলেন। পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিতে সাউন্ড গ্রেনেড টিয়ারশেল ছোড়ে। এরমধ্যে সেখানে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ প্রবেশ করে। পুলিশের গুলি আর ছাত্রলীগের ধাওয়ায় তারা পেছনে হটতে শুরু করেন। এরমধ্যে ছাত্রলীগের গ্রুপটি থেকে একজন তাদের দিকে লাঠি ছুড়ে মারে। লাঠির আঘাতে শাবাব নামে আভাসের এক বন্ধু মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় শাবাবকে উঠাতে গেলে ছাত্রলীগের একজন তাদের দিকে ছররা গুলি ছোড়ে। ওই ছররা গুলি শাবাব আর আভাসের শরীরে গিয়ে লাগে। আভাসের হাতে এসে ৬-৭টি গুলি লাগে। তবে শাবাবের শরীরে বেশি গুলিবিদ্ধ হয়। ছররা গুলি ছাত্রলীগের ওই গ্রুপ থেকেই ফায়ার করা হয়েছে। আভাস বলেন, হাসিনার পতন না হলে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল।

‘পুলিশের ছররা গুলি কেড়ে নিয়েছে গালিবের চোখ’: জুলাই আন্দোলনে আহত আরেক শিক্ষার্থী আসাদুল্লাহ হিল গালিব। তিনি চলতি বছর  বগুড়া মোস্তাফাবিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছেন। জুলাই আন্দোলনে গিয়ে তিনি আজিজুল হক কলেজ সংলগ্ন কামারগাড়ী মোড় এলাকায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় পুলিশের ছররা গুলিতে তার ডান চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। গালিব বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা দেওতাগ্রামের ফেরদৌস রহমানের ছেলে। ঘটনার বিস্তারিত বলতে গিয়ে গালিব বলেন, হাসিনা সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে আবু সাঈদের বুক পেতে দেয়ার সাহস আর আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মম নিপীড়নের চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেখে তিনিও নিজেকে ঘরে আটকে রাখতে পারেননি। তাই তার মাদ্রাসার সহপাঠী, বন্ধু এবং মেসের বড় ভাইদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। সেদিন ১৮ই জুলাই ছিল। ওইদিনই তার প্রথম আন্দোলনে যাওয়া। তাদের পরিকল্পনা ছিল আজিজুল হক কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সাতমাথায় যাওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী কলেজ থেকে বিক্ষোভ করতে করতে তারা এগোচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কামারগাড়ী এলাকায় পৌঁছালে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ প্রথমে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এরপর ছররা গুলি ছুড়তে শুরু করে। ওই সময় গুলি এসে তার চোখসহ শরীরে বিভিন্নস্থানে বিঁধে যায়। 

গালিব বলেন, চোখের ভেতরে বিদ্ধ হওয়া গুলি চোখের অনেক গভীর পৌঁছে যাওয়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বুলেট বের করা সম্ভব না। এরপর ডাক্তারদের পরামর্শে ১৮ই জুলাই তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকায় পৌঁছার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাদের এম্বুলেন্স আটকায়। পরে তারা যখন জানতে পারে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত তখন তারাই  এম্বুলেন্সটি গার্ড দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেক বাধা পেরিয়ে একসময় হারুন আই ক্লিনিকে পৌঁছায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয় তাকে। এরপর ভিশন আই হসপিটালে রেফার্ড করা হয়। সেখানেই তার চোখের অপারেশন হয়। তার চোখের ভেতর থেকে বুলেট বের করা হয়। ওই অপারেশনের পর আরও দুইটি চোখের অপারেশন হয়। অপারেশনের পর কিছুদিন চোখে ঝাপসা দেখতে পাচ্ছিলেন গালিব। তবে বর্তমানে তার ওই চোখ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।

‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধেও আন্দোলন করতে হয়েছে এটা দুঃখজনক’ তৌহিদ হোসেন: ১৮ই জুলাই থেকে ৪ঠা আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন আন্দোলনে ছিলেন বগুড়ার বিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী তৌহিদ হোসেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের নির্মম নিপীড়ন আর আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে গুলি করার দৃশ্য দেখে তিনিও  স্বেচ্ছায় আন্দোলনে যোগ দেন। আন্দোলনে গিয়ে তিনি ৪ঠা আগস্ট পুলিশের ছোড়া ছররা এবং চাইনিজ বুলেটে আহত হন। তৌহিদ বগুড়ার উপশহর এলাকার ফারুক হোসেনের ছেলে। 

তৌহিদ হোসেন বলেন, সেদিন দুপুরের দিকে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রথম তিনি শহরের সেলিম হোটেল সংলগ্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন। তার হাতে, বাম পায়ের উরুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বুলেট বিদ্ধ হয়। কিন্তু সেগুলোর ব্যথা শরীরে থাকলেও সহ্য করতে পারছিলেন। তাই তিনি আন্দোলনে থেকে যান। এরপর সাতমাথায় যান। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে শহরের সাতমাথায় অবস্থিত বগুড়া কলেজের সামনে শেরপুর রোডে রাস্তায় ব্লক ফেলে ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন। এ সময় তার একবন্ধু এবং আন্দোলনের আরেক সহযোদ্ধা ছিলেন। ব্যারিকেড দিতে গিয়ে তিনি হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখেন পুলিশ বন্দুক তাক করেছে তার দিকে। সেটা দেখে তিনি সামনের দিকে দৌড় দেন। এ সময় ওই পুলিশ গুলি করলে তার বাম পায়ের তালু গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর তার সহযোদ্ধারা তাকে জিলা স্কুলের পেছনের গলি দিয়ে আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠের দিকে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় তিনি বগুড়ার মাটিডালিতে অবস্থিত হেলথ ভিলেজ ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা নেন। 

তৌহিদ বলেন, ক্লিনিকের ডাক্তার তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। গুলিবিদ্ধ স্থানে ড্রেসিং করে দেন। কিন্তু তিনি গান পাউডার ঠিকমতো পরিষ্কার করতে পারেননি। তাই তার ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হওয়ার পর্যায়ে গিয়েছিল। এজন্য ২৬শে আগস্ট বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি হতে হয়। সেখানকার চিকিৎসক তার পায়ের সার্জারি করে। সেখান থেকে রিলিজ দেয়ার পর কিছুদিন ভালো থাকলেও পায়ের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় অক্টোবরে আবারো ভর্তি হতে হয় তাকে। এভাবে সমস্যার মধ্যেই তিনি দিন পার করছিলেন। তবে গত ৩ মাস হলো তিনি ঠিকঠাক মতো চলাফেরা করতে পারছেন। 

তৌহিদ আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ যে অপরাধগুলো করে গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল, প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের উচিত ছিল, ৫ই আগস্টের পর থেকেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে আবারো আমাদেরই আন্দোলন করতে হলো। এটা দুঃখজনক। এ ছাড়া লাশ নিয়ে রাজনীতি, এনসিপি গঠন এগুলো কোনোকিছুই আমার ভালো লাগেনি।