
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার একদিন আগে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল ফেনীতে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিল ৮ যুবক। সরকার পরিবর্তনের পরে সাতজন যুবকের পরিবারের স্বজনরা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিল। কিন্তু ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হলেও শুরু হয়নি কোনো মামলার বিচারকাজ। ছেলে হারানোর কান্না বুকে চেপে নিয়ে বিচারের প্রত্যাশায় দিন গুনছেন স্বজনরা।
সেদিন যা ঘটেছিলো: জুলাই জুড়ে ঢাকাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলেও ফেনীতে মধ্য জুলাই থেকে সক্রিয় হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার পরপরই ফেনীতে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা প্রতিনিয়ত সড়কে নেমে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। গত বছরের ৪ঠা আগস্ট ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ‘সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি’। এদিন সকাল থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ জড়ো হতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপাল এলাকায়। এ সময় হাতে লাঠি ও ইটের টুকরোসহ অবস্থান নিয়ে স্ল্লোগান দিতে থাকেন বিক্ষোভকারীয়া। আন্দোলনরতদের বিক্ষোভ চলাকালে শহরের পৌরসভা চত্বর থেকে মোটরসাইকেলে চড়ে তৎকালীন সরকারদলীয় সশস্ত্র কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করে ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়ক দিয়ে মহিপালে এগুতে থাকে। শতাধিক দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মুহুর্মুহু গুলি চালাতে চালাতে আওয়ামী লীগ, ও তার অঙ্গসংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান পাঁচজন শিক্ষার্থী। গুলিবিদ্ধ হন শতাধিক শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ। ঘণ্টাব্যাপী হামলার পর দুপুর আড়াইটা থেকে একের পর এক গুলিবিদ্ধদের নিয়ে আসা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে। এদের মধ্যে ৫ জনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। অপর ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হাওয়ায় তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম স্থানান্তর করা হয়। পথে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়। ওইদিন সন্ধ্যার পর শহরের শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়কে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। পরদিন পাঁচই আগস্ট সকালে ফেনীর ট্রাংক রোড এলাকায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। দুপুরে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পালিয়ে যায় আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা।
জুলাই জুড়ে হামলায় যারা শহীদ হয়েছিল: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতনের আন্দোলনে জুলাই জুড়ে ফেনী ও ফেনীর বাহিরে আন্দোলনে জেলার ১১ জন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। নিহতরা হলেন- শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ (শ্রাবণ), মো. মাহবুবুল হাসান (মাসুম), মো. সারোয়ার জাহান (মাসুদ), ওয়াকিল আহমেদ (শিহাব), ছাইদুল ইসলাম (শাহী), জাকির হোসেন শাকিব, সাইফুল ইসলাম আরিফ, মো. ইকরাম হোসেন কাউসার, মো. আবু বক্কর সিদ্দিক (শিবলু), মো. আব্দুল গনি (বোরহান) ও অটোরিকশাচালক মো. সবুজ। এদের মধ্যে জুলাই শহীদ গেজেটে শহীদদের তালিকা ফেনীর ১০ জনের নাম থাকলেও অটোরিকশাচালক মো. সবুজের নাম নেই। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিহতদের তালিকায় জুলাইযোদ্ধা ছয়জনের নাম রয়েছে। ফেনীতে নিহত সাতজনের স্বজনরা থানায় সাতটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ফেনীর ১১ জন নিহতের মধ্যে চট্টগ্রামে সংঘর্ষে একজন ও ঢাকায় সংঘর্ষে দু’জন নিহত হন।
জেলায় আহতদের তালিকায় সরকারি গেজেটে ‘ক’ ক্যাটাগরিতে ৫ জন, ‘খ’ ক্যাটাগরিতে ৩০ জন, ও ‘গ’ ক্যাটাগরিতে ৩৪২ জন রয়েছেন। তবে আহতের স্থানীয় তালিকায় ৪০৭ জনের নাম রয়েছে। এদের মধ্যে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারিয়েছেন একাধিকজন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছররাগুলি নিয়ে এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন আহতরা।
মামলার যা অবস্থা: জুলাই জুড়ে হামলা ও সংঘর্ষে এবং ৪ঠা আগস্ট মহিপালের গণহত্যার ঘটনায় ফেনী সদর মডেল থানায় ৭টি হত্যা মামলা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের হয়েছে। এই ২২টি মামলায় এজহারনামীয় আসামি হয়েছেন ২ হাজার ১৯৯ জন ও অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে চার হাজারেরও বেশি জনকে। বিগত এক বছরে এজহারনামীয় ও অজ্ঞাত মিলিয়ে সহস্রাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র?্যাব। এদের মধ্যে ঘটনার দায় স্বীকার করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ১১ জন।
এদিকে ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রহিম উল্যাহ, সাবেক সাংসদ নিজাম হাজারীর ব্যক্তিগত সহকারী ও যুবলীগ নেতা ফরিদ মানিক ওরফে পিএস মানিক, ফেনী পৌর কাউন্সিলর খালেদ খান, জেলা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক শাহজাহান সাজু, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন বাহার সহ পদ-পদবিধারী শতাধিক নেতা গ্রেপ্তার হলেও অনেকেই জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
ফেনী পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মামলাগুলোর মধ্যে গত ৩১শে জুলাই ফেনীর আদালতে কলেজ শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম (২৫) হত্যা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে পুলিশ। ওই অভিযোগপত্রে হাসিনা, কাদের সহ ২২১ জনের নাম রয়েছে। অপরাপর মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।
নিহতদের স্বজন ও আহতদের হতাশা: মহিপালের গণহত্যায় নিহত স্বজনদের চোখের জল এখনো ফুরায়নি। সন্তান হত্যার বিচারের আশায় দীর্ঘ এক বছর ধরে তারা বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করছেন। ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই সনদ ঘোষণা না করায় এসব স্বজন হতাশ হয়েছেন। শহীদ ইফতিয়াক আহমদ শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলী বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে আমার একমাত্র ছেলে শ্রাবণকে আমি হারিয়েছি। আজ এক বছর হতে চললো এখনো আমার ছেলে হত্যার বিচার শুরু হয়নি। ছেলে হত্যার বিচার দ্রুত দেখে যেতে চাই।
আহত জুলাইযোদ্ধা মো. আবুল হাসান শাহীন বলেন, ‘আমার গলায় এখনো যেগুলিটি রয়েছে সেটি চিকিৎসকরা বের করতে পারেননি। আমরা যে আশা নিয়ে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম বিগত একবছর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে দেশ পরিবর্তনের এমন কোনো প্রত্যাশা মেলেনি। কয়েকটি রাজনৈতিক দল আবারও আওয়ামী ফ্যাসিস্টের কায়দায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ চাই, আর কোনো শিক্ষার্থী যেন সড়কে নেমে আন্দোলন করে সরকার পরিবর্তন করতে না হয় সেজন্য সকলকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।