
৪ঠা আগস্ট, ২০২৪। সিলেটের ইতিহাসে কালো দিন। এ দিন রাজপথে হয়েছে ভয়ঙ্কর সব অস্ত্রের মহড়া। সকালে কোর্ট পয়েন্টে ছিলেন বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। দুপুর থেকেই ওই এলাকা দখলে নেয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। হাতে ছিল স্নাইপার, একে ৪৭, এমআর সিক্সটিনের মতো ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র। তারা শুধু অস্ত্র প্রদর্শনই করেনি, নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ছুড়েছে। রক্তে লাল হয়েছে সিলেটের রাজপথ। একদিকে ছিল অস্ত্রধারী ক্যাডাররা, অন্যদিকে নিরস্ত্র জনতা। এই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সিলেটে ওই দিন তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। দিনভর বাসাবাড়িতে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন মানুষ।
গণ-অভ্যুত্থানের পর অস্ত্র এবং অস্ত্রবাজদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের বিষয়টি সিলেটে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখনো ধরা পড়েনি কোনো অস্ত্রধারী। তবে কারা কী ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে সেসব বিষয় ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। রুহুল আমিন শিবলু নামের এক অস্ত্রবাজের ছিল মারণাস্ত্র। তিনি লন্ডন প্রবাসী। গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বে সিলেটে এসেছিলেন। পরে পালিয়ে লন্ডনে চলে যান।
অনেকেই বলছেন; তার হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল। আর ওই অস্ত্র দিয়ে তাকে নগরের কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। এ ছাড়া যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগের কিশওয়ার দিলোয়ার, নাঈম আহমদ, চিহ্নিত সন্ত্রাসী আফতাব হোসেন খান, তার সহযোগী পাঙ্গাস আলী, কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, দেবাংশু দাস মিঠু, মিঠু তালুকদার ওরফে ভাগনে মিঠু, পীযূষ কান্তি দে, অরুন দেবনাথ সাগর, বিক্রম কর সম্রাট, সজল দাস অনিক, দেলোয়ার হোসেন রাহি, হাবিবুর রহমান হাবিবসহ অনেকের হাতে অস্ত্র দেখা যায়। শটগান হাতে দেখা যায়, যুবলীগ নেতা জাহেদকে। মুনিম অখিলি, সজল দাশ অনিক, শান্ত, টিলাগড়ের আলোচিত ভয়ঙ্কর অস্ত্রবাজ আনসার, এমসি কলেজের দেলোয়ার হোসেন রাহী, সরকারি কলেজের রুহেল আহমদ, সাজন আহমদ, ছাত্রলীগের তানভীর, কাশ্মীর গ্রুপের সৈকত চন্দ্র রিমি, গৌরাঙ্গ দাশও সশস্ত্র অবস্থায় রাজপথে ছিলেন। সিলেট নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সিলেটের রাজপথে ওই সময় যারা আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করেছিলেন তারা এখনো লাপাত্তা। তালিকা করে তাদের খোঁজা হচ্ছে। লাপাত্তা থাকার কারণে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তিনি ধারণা করেন প্রদর্শিত সব আগ্নেয়াস্ত্র সিলেট থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনের পরদিনই গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার কারণে অস্ত্রধারী পালিয়ে গেলেও অস্ত্র সরাতে পারেনি। কেউ কেউ অস্ত্র হাতবদল করে যেতে পারে। এজন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সিলেটে প্রায় ১৪০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার। সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকায় ১০৩টি মামলা হয়েছে। পুলিশের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার জনকে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাই বেশি। এক বছরে নগর পুলিশের অভিযানে ৫৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে এজাহারনামীয় আসামি ২১৩ জন। অন্যরা সন্দেহভাজন। ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের দিন সিলেটের ৬টি থানা থেকে ১০১টি পুলিশের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে ৮৩টি অস্ত্র উদ্ধার হলেও এখনো ১৮টি অস্ত্র বাইরে রয়েছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম মানবজমিনকে জানিয়েছেন, অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রবাজদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে গত এক বছরে যে মামলা হয়েছে, সেই মামলা নিয়ে পুলিশকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এসব মামলা তদন্ত, অনুসন্ধান সবই করতে হচ্ছে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে দায়ের করা মামলার অনেক তদন্ত কাজ এগিয়ে রাখা হয়েছে। এসব মামলায় চিহ্নিত অস্ত্রবাজরাও আসামি। ফলে পুলিশ তদন্ত, গ্রেপ্তার সবই একসঙ্গে করছে। ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের দিন সিলেট জেলা পুলিশের বিভিন্ন থানাও আক্রান্ত হয়েছে। খোদ সিলেটের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ছাড়াও ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। এতে করে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিলেট জেলা পুলিশের কার্যালয়। বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট সহ কয়েকটি থানায় ভাঙচুর করা হয়। ওই সময় পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্রও লুট করা হয়।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সিলেটের ১৩টি থানা পুলিশের পক্ষ থেকে ৩৯টি মামলা দায়ের করা হয়। সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন- সিলেট জেলা পুলিশেরও অস্ত্র খোয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি ফেরত এসেছে। যেগুলো ফেরত আসেনি সেগুলো উদ্ধারে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। তিনি জানান, গত এক বছরে পুলিশের নজর বেশি ছিল অস্ত্র উদ্ধারে। একই সঙ্গে আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্তও চলছে বলে জানান তিনি।