Image description

১৬ই জুলাই, ২০২৪। কোটা সংস্কার আন্দোলনে উত্তাল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। পুলিশের একাধিকবার লাঠিচার্জ, রাবার বুলেটের সামনে থেকে কিছুটা পিছু হটে শিক্ষার্থীরা। তখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা অসহায়। হয় তো এই কোটা সংস্কার রংপুরের আন্দোলনের ইতি এখানেই ঘটতে পারতো। কিন্তু কে জানতো এ আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ এখনো জ্বলা বাকি। বেলা আড়াইটার সূর্যের তাপে উত্তপ্ত হওয়া রাস্তার পিচ দিয়ে হেঁটে আসছে এক তরুণ যুবক। সামনে বন্দুক হাতে পুলিশ। তবুও নেই কোনো ভয়। যুবকটিকে হেঁটে আসতে দেখে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে অবস্থানরত পুলিশ বন্দুক হাতে তৈরি। পুলিশের ১৫ মিটার সামনে গিয়ে নির্ভয়ে দু’হাত প্রসারিত বুক পেতে দাঁড়িয়ে গেল নিরস্ত্র যুবকটি। ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’- একথাটির বাস্তব উদাহরণ সেদিন দেখেছে রংপুরবাসী। পুলিশের প্রথম ফায়ার গিয়ে লাগলো যুবকটির শরীরে, তবুও সে সরে দাঁড়ালো না। দ্বিতীয়বার বুক পেতে দিলো সে। আবারো পুলিশের গুলি। তবে এবার আর দাঁড়াতে পারলো না সে। কিছুদূর পিছিয়ে সড়কের উত্তপ্ত পিচে পড়ে গেল। সহযোদ্ধারা এগিয়ে এসে নিয়ে দ্রুত নিয়ে গেল হাসপাতালে। কিন্তু বাঁচানো গেল না সেই বীরকে। সে বীর আবু সাঈদ। বন্দুকের নলের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে বুকে গুলি বরণ করে নেয়ার দৃশ্য গণমাধ্যমে দেখেছে পুরো দেশ, পুরো বিশ্ব। আবু সাঈদের বীরত্বপূর্ণ সে দৃশ্য যেন দেশবাসীর রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যা ছিল এ আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। 

জুন-জুলাইয়ের প্রথম পক্ষে রংপুরে বিচ্ছিন্নভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন চললেও ১৬ই জুলাই আবু সাঈদ শহীদের পর ফুঁসে ওঠে রংপুরসহ দেশবাসী। ‘হামার ব্যাটাক মারলু ক্যানে’-এমন ক্ষোভ নিয়ে রাজপথে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন পেশার মানুষ। তখন এ ছাত্র আন্দোলন হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতার আন্দোলন।

১৭ই জুলাই বুধবার আবু সাঈদ হত্যা মামলায় মাত্র ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মো. আলফি শাহরিয়ার মাহিমকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলে রংপুর মেট্রো পুলিশ। পরে মাহিমকে কারাগারে প্রেরণ করেন আদালত। যা দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করে।  ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ অফিস, জাতীয় শ্রমিক লীগ অফিস, মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবি কার্যালয়, তাজহাট থানা, নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

গুরুত্বপূর্ণ দিন: পুরো জুলাই জুড়ে আন্দোলন চললেও আবু সাঈদ শহীদের পর রংপুরে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৯শে জুলাই ও ৪ঠা আগস্ট। ১৯শে জুলাই শুক্রবার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল রংপুর। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্রের মহড়ায় নগরীতে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা নগরীতে মারমুখী হয়ে ওঠে। পুলিশে সঙ্গে একাধিক স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ছাত্র-জনতার।
এদিন সমবায় মার্কেটের দোকানের কাঁচ ঢিল ছুড়ে ভেঙে ফেলা হয়। এ ছাড়া পায়রা চত্বরে মেট্রোপলিটন পুলিশের দেয়া লোহার ডিভাইডার, বিভিন্ন ট্রাফিক সাইনবোর্ড, সুপার মার্কেটের কাছে ট্রাফিক আইল্যান্ড ভেঙে ফেলে আন্দোলকারীরা। এ ছাড়া নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টের সড়কে তারা আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। চলতে থাকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ। পুলিশ আন্দোলনকারীদের দমনে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করছিল। এতে কয়েকজন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ভর্তি হয়। যার মধ্যে শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল তাহির, সবজি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেন, ফল বিক্রেতা মেরাজুল ইসলাম ও স্বর্ণশিল্পী মুসলিম উদ্দিন মিলন মারা যান। পরে পুলিশ-প্রশাসনের চাপে ময়নাতদন্ত না করেই লাশ দাফন করেন তাদের পরিবার।

৪ঠা আগস্ট রংপুরে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অসহযোগ আন্দোলনকারী ও আওয়ামী লীগ মুখোমুখি। এদিন সকাল ১০টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নগরীর টাউন হলের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তারা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। আধাঘণ্টার মধ্যে টাউন হলের সামনের সড়ক জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এদিকে, বেলা সাড়ে ১২টায় দলীয় কার্যালয় থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কয়েকশত নেতাকর্মী দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোটা, ইটপাটকেল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে আন্দোলনকারীরাও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা এক ব্যক্তিকে আন্দোলনকারীদের ওপর পিস্তল দিয়ে গুলি করতে দেখা যায়, যা ধরা পড়ে মানবজমিনের ক্যামেরাতেও। সংঘর্ষস্থলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা খাইরুল ইসলাম সবুজ (২৮) ও মাসুম (৩০) নিহত হয়। এ ছাড়াও রংপুর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর হারাধন রায় হারা ও তার দেহরক্ষী শ্যামলকেও হত্যা করা হয়।

এরপর আসে ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত সেই ৫ই আগস্ট। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের খবর পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে রংপুরের সর্বস্তরের মানুষ। বৃষ্টিতে ভিজে কেউ বা উল্লাস করছে আবার কেউ বা সিজদায় লুটিয়ে পড়ছে। 

পুলিশের গুলিতে সড়কে লুটিয়ে পড়া আবু সাঈদকে বাঁচাতে প্রথম এগিয়ে আসা জুলাইযোদ্ধা সিয়াম আহসান আয়ান এক বছরে সেই দগদগে স্মৃতি হৃদয়ে অক্ষত রেখেছেন। আয়ান বলেন, আবু সাঈদ ভাইয়ের আত্মত্যাগের দৃশ্য আজও স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করছে। আমি চাই আবু সাঈদ হত্যার সুষ্ঠু তদন্তসহ আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা আইনজীবী জোবাইদুল ইসলাম বুলেট বলেন, আবু সাঈদ ছিলেন সরকার পতনের টার্নিং পয়েন্ট। আবু সাঈদের এ আত্মত্যাগ হাজার বছর বুকে ধারণ করে রাখবে দেশবাসী।