
পাঁচই আগস্ট ২০২৫। এক রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের দিন। যেদিন ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে উড়ে যায় ফ্যাসিবাদী শাসনের মসনদ। ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। শত শত মানুষের জীবন দান আর পঙ্গুত্ব বরণের মধ্যদিয়ে আসা ৫ই আগস্টের বিজয় স্বাধীন দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ছাত্র-জনতার এই রক্তাক্ত বিজয় একটি নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলে। বিজয়ের পরপরই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা পথে নেমে সেই স্বপ্নগুলো এঁকে দেয় দেয়ালে দেয়ালে। কিন্তু অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে বিপ্লবের নায়ক ছাত্র-জনতার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নজিরবিহীন নৃশংসতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছে এখনো এর বিচার দৃশ্যমান হয়নি। পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা দিয়ে মানুষ রাজপথে নেমে অকাতরে জীবন দিয়েছে পরিবর্তন এখনো অধরাই রয়ে গেছে। অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া শক্তিগুলো নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল তাও এখন ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সামনে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা ও সেই সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে এ নিয়েও শঙ্কা সংশয় তৈরি হয়েছে মানুষের মাঝে। অভ্যুত্থানের মূল শক্তি শিক্ষার্থী-তরুণদের প্রত্যাশা পূরণে বড় কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি এই সময়ে। এ ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাও এক বছরে প্রত্যাশিত পর্যায়ে আসেনি। সংস্কারের জন্য গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখনো সব দলের সম্মতি নিয়ে কাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদ ঘোষণা করতে পারেনি।
এমন অবস্থার মধ্যেই আজ সারা দেশে পালিত হবে গণ-অভ্যুত্থান দিবস। দিবসটি উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। এদিন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে আজ বিকালে জুলাই সনদ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ হাসান। জুলাই বিপ্লবে ছিলেন সম্মুখসারিতে। ছররা গুলির আঘাতে আহত হয়েছিলেন। মুখে আটটি সেলাই পড়ে তার। এখনো পায়ে ব্যথা নিয়ে চলছেন। কখনই সরকার থেকে কোনো সুবিধা নেননি। জুলাই ফাউন্ডেশনেও নাম লেখাননি। এই শিক্ষার্থী বলেন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তিটাই বেশি। শিক্ষার্থীদের-গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আন্দোলনের সময় কিংবা এর পরবর্তী এক মাসে বাংলাদেশের মানুষ দেশকে যতটা ভালোবেসেছিল, রাজনৈতিক দলগুলো এই ভালোবাসাটা নষ্ট করেছে।
ইয়ামিন হোসেন রাতুল। বাবাহারা রাতুল নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছিলেন। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় আম্মুর ফোন ধরতাম না। আম্মু ফোন দিলেই বলেন, বাসায় চলে আসতে। আমি বলতাম- তোমার ছেলে কাপুরুষ না। আম্মু শুধু বলতেন, তোর কিছু হলে আমার কী হবে? আমি উত্তরে কিছু বলতে পারতাম না। এক বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে তিনি বলেন, আমরা সংস্কার বুঝি না। আমরা বুঝি দেশ। একটা লেখা পাতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করবেন এটার জন্য রাস্তায় নামি নাই। আমরা জানতাম না সামনে কী? পুলিশ গুলি করবে নাকি গুণ্ডারা তুলে নেবে। তিনি বলেন, এক বছরে আওয়ামী লীগের বিচার কেন হলো না? কেন জুলাই সনদ হলো না?
যুগে যুগে বিপ্লবে শক্তিশালী অস্ত্র ছিল স্লোগান। ’২৪ এর মোটা হরফে লেখা স্লোগান ‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা’ ঝড় তুলেছিল আন্দোলনে। এই আন্দোলনের বিজয়ের এক বছর পর চাকরিতে মেধার বিচারে বৈষম্যের হাত থেকে কতোটা মুক্ত হয়েছে দেশ? সরকারি চাকরি বিশেষ করে বিসিএস হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সোনার হরিণ। বাংলাদেশ কর্ম কমিশন (বিপিএসসি) চেষ্টা করছে দুর্ভোগ লাঘবের। কিন্তু শিক্ষার্থীরা স্লথ গতিতে অখুশি। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া সৌরভ কুমার সাহা বলেন, পুরনো নিয়মেই চলছে বিপিএসসি। তারা শুধু গতি বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন। তাদের উচিত ছিল নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সরকারি চাকরির শূন্য পদ পূরণ করা। কিন্তু তারা ৪৪তম বিসিএস’এ সেই পুরনো রিপিট ফল প্রকাশ করলেন। ফল পরিবর্তনের আভাস মিলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চাই নতুনত্ব। আমাদের নিয়তি হচ্ছে আন্দোলন। আওয়ামী আমলেও আন্দোলন করতে হয়েছে। এখনো তাই করতে হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এখন ভয় করে না।
ওদিকে যে কলুষিত রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষ পথে নেমেছিল এখনো সেই রাজনীতির পরিবর্তনের বার্তা স্পষ্ট হচ্ছে না। চাঁদাবাজি, মব সন্ত্রাস আতঙ্কিত করছে মানুষকে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো মানুষকে আশা দেখাতে পারছে না।
একটি নতুন দলের সদস্য ও একজন জুলাইযোদ্ধা বলেন, নতুন দল সাধারণ জনতার ভাষাটাই ধরতে পারেননি। ওয়াকিটকির ভাষা জনতা পছন্দ করে না, ফেসবুকের কঠিন ভাষা বোঝে না। জনতা বোঝে সহজ কথা, যে কথাতে তারা নিজেকে রিলেট করতে পারে। তিনি আরও বলেন, পুরনো দলের চাঁদাবাজি যতটা মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তার থেকে বেশি ক্ষুব্ধ হয় শিক্ষার্থীদের চাঁদাবাজিতে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শামীমা সুলতানা। তিনি জুলাই আন্দোলন জুড়ে করেছিলেন দ্বিধাহীন উচ্চারণ। গত বছর স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে ১লা আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি বলেছিলেন ‘যার হাতে আমার সন্তানের রক্ত, সেই খুনির ছবি আমি আমার দেয়ালে রাখতে চাই না’। এই মন্তব্য করে তার কার্যালয় থেকে শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে ফেলেছিলেন। সেই শামীমা সুলতানা জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির সময়ে নিজের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, শিক্ষার্থীদের একটা বড় প্রত্যাশার জায়গা পূরণ হয়েছে। হলে হলে এখন তারা সিট পাচ্ছেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে বলা যাবে না যে, শিক্ষার্থীদের আশা পূরণ হয়েছে। বৈষম্য দূর হয়েছে এটা আমি বলবো না। নিরাপত্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর ক্ষমতায়ন কোনোটাই প্রত্যাশিতভাবে পরিবর্তন হয় নাই। তবে আমি এটাও বলবো, এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নাই। এখন কথা বলতে পারছি এটা ভালো দিক। মানুষ যদি তার ভোটাধিকার, গণতন্ত্র ফিরে পায় তাহলে বৈষম্য দূর হবে। আমাদের প্রত্যাশাটা আসলে গণমানুষের রায়ে যে সরকার আসবে তাদের কাছে বেশি। গণতান্ত্রিক এই সরকার আসলে আমাদের বৈষম্যগুলো দূর যদি করে, তাহলেই আমি বলবো শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।