
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা কোটা সংস্কার আন্দোলন গত বছরের ৪ আগস্টে এসে কার্যত সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচির প্রথম দিন ছিল এদিন।
এই কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নজিরবিহীন সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। দিনশেষে তাত্ক্ষণিকভাবে ৯৮ জনের মৃত্যুর কথা জানালেও পরে গণমাধ্যমগুলো এদিন ১১৪ জন পর্যন্ত নিহত হয় বলে সংবাদ প্রকাশ করে।
এদিকে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির অংশ হিসেবে পরদিন ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীরা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করে সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানান। প্রথমে ৬ আগস্ট এই কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে তা এক দিন এগিয়ে আনা হয়। এর আগে বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বিজয় এবং একমাত্র বিজয়ই আমাদের লক্ষ্য।
এদিন সকাল থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে জড়ো হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। সড়কে অবস্থান নেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা ও উপজেলা সদরে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবত্ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরদিন ৫ আগস্ট থেকে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কারফিউয়ের মধ্যে সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের আলোকে তার প্রতিশ্রুত দায়িত্ব পালন করবে।
গণভবনে নিরাপত্তাসংক্রান্ত বৈঠক শেষে নৈরাজ্যবাদীদের দমন করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন যারা নাশকতা করছে, তারা কেউই ছাত্র নয়; তারা সন্ত্রাসী।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘জঙ্গি হামলা’ হচ্ছে জানিয়ে সতর্ক করে সরকার। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক সবাইকে নিরাপদে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। জঙ্গি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এদিন আবারও বন্ধ করা হয় মোবাইল ইন্টারনেট। গণমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এদিন দুপুর ১২টার পর সরকারি একটি সংস্থার নির্দেশে ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়। সেই সঙ্গে মেটার প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম বন্ধের নির্দেশ দেয় সরকারি একটি সংস্থা। দেশের অন্তত ৩৮টি জেলায় জনপ্রতিনিধিদের বাসা, আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও থানাসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষে অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়। ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল সারা দেশ থেকে। গণপরিবহন চলাচল ছিল না বললেই চলে। দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ছেড়ে যায়নি। অনেকটা রাজধানীর মতোই চিত্র ছিল দেশের বিভিন্ন জেলা ও শহরে। সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সিরাজগঞ্জ। সংঘর্ষ ও মারধরে ১৩ পুলিশ সদস্যসহ ২৩ জনের মৃত্যু হয়।
এদিকে রাজধানীর রাওয়া ক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সামরিক বাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনসহ সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করে। এতে শিক্ষক, বিচারক, আইনজীবী ও সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া চালুর আহ্বান জানানো হয়। রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রস্তাব তুলে ধরেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।