
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পালে হাওয়া লেগেছে। গতি ফিরেছে সব ধরনের কাজে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও ব্যবসায়ী নেতার দুর্নীতির বিষয়ে চুপ ছিল দুদক, এখন তাদের বিরুদ্ধে সরব। রাঘববোয়ালরাও রেহাই পাচ্ছেন না। পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই ফেঁসেছেন দুদকের জালে। পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সাত সদদ্যের নামে পৃথক ছয়টি মামলা করে দুদক। শেখ পরিবারের ৭ সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত।
অনুসন্ধান শুরুর পর অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিটও দেওয়ায় বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের তুলনায় কর্মরত আমলাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হার তুলনামূলক কম। তবে ছোট খাটো সাবেক-বর্তমান অনেক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুদক থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের মতোই রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ করছে দুদক। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে তখনকার সরকারের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদক আগ্রহ দেখায়নি। গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সব নেতা পালিয়ে যাওয়ায় দুদক এখন গণহারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস দেখাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কোনো উপদেষ্টা ও আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ উঠলেও তাদের ব্যাপারে নীরব দুদক। তবে দু’জন উপদেষ্টার এপিএস ও পিওর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। উপদেষ্টাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এপিএস-পিওরা দুর্নীতিতে জড়াতে পারে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, ‘দুদক আইনের মধ্যে থেকে নিজস্ব গতিতেই কাজ করছে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে নিয়ম অনুযায়ী যাচাই-বাছাই শেষে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কমিশন। অনুসন্ধান শেষে মামলা ও চার্জশিট দেওয়ার কাজও চলছে। এক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের রাজনৈতিক কিংবা পেশাগত পরিচয় দেখা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান অনুসন্ধান, মামলা ও চার্জশিটেও সেটা দৃশ্যমান।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর গত বছরের আট আগষ্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরই মূলত দুদকের পালে হাওয়া লাগে। নিজেদের চেয়ার রক্ষার তাগিদে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ কমিশন নড়েচড়ে বসে। তারা একের পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। তারপরও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। পদত্যাগ করে সরে যাওয়ার পর দায়িত্ব নেয় আবদুল মোমেন কমিশন। এই কমিশনে কাজের গতি আরও বাড়ে।
দুদক থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত ১১ মাসে রাঘববোয়ালসহ দুই হাজার ৭৮৮ দুর্নীতিবাজ দুদকের জালে ফেঁসেছেন। যারা সরাসরি অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিভিন্ন মামলা বা চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েছেন। তাদের মধ্যে এক হাজার ৪৩২ জন মামলার ও এক হাজার ৩৫৬ জন চার্জশিটভুক্ত আসামি। এর মধ্যে ৩৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ১১৪ জন, ৯২ জন রাজনীতিবিদ এবং ৭১৫ জন বেসরকারি চাকরিজীবীসহ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
জানতে চাইলে দুদকের উপ-পরিচালক মো. আকতারুল ইসলামও স্বীকার করেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কমিশনের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে গতি এসেছে। পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে বিশেষ করে গত ৬ মাসে অভিযোগ, মামলা ও চার্জশিট বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর দুদকের কাজের গতি বেশ বেড়েছে। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে পাঁচ হাজার ৯২৯টি, অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৫৩০টি, মামলা হয়েছে ২৫৫টি, চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ১৭৫টি, চার্জশিটভুক্ত আসামি ৫৩৮ জন। এ সময়ে দায়ের করা দুদকের মামলার মোট আসামি ৯৮৩ জন। যার মধ্যে রাজনীতিবিদ ৬৮, সরকারি চাকরিজীবী ২১১ ও জনপ্রতিনিধি ১৪ জন।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মতে, আওয়ামী সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত ১১ মাসে ১২ হাজার ৮২৭টি অভিযোগ দুদকে জমা হয়েছে। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ৭৬৮টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়। এ সময়ে ৩৯৯টি মামলা ও ৩২১টি মামলার চার্জশিট দেয় দুদক। মাস হিসাবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সর্বাধিক ৭০টি ও ৫৪টি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় আসামিদের মধ্যে ৩৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ১১৪ জন, ৯২ জন রাজনীতিবিদ। এসময়ে দুদকের জালে ফেঁসেছেন মোট এক হাজার ২৬৪ দুর্নীতিবাজ। এ সময়ের মধ্যে ২২৩ জনের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দিয়েছে সংস্থাটি। একই সময়ে ৯টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) করা হয়েছে।
এর আগে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৪৩৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়। ২২৭টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) হয় এবং ৪৮টি মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ সময়ে ৩২৮টি মামলা ও ৩৪৫টি মামলার চার্জশিট দিয়েছিল দুদক। এরই মধ্যে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ আওয়ামী সরকারের পতনের পর আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রেকর্ডসংখ্যক অনুসন্ধান শুরু হলেও হঠাৎ মঈনউদ্দীন কমিশনের পদত্যাগে ছন্দপতন ঘটে। তবে আবদুল মোমেন কমিশন দায়িত্ব নিলে কাজে গতি ফিরে।
২০০৪ সালে গঠিত কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। এরপর যথাক্রমে সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরী, গোলাম রহমান, মো. বদিউজ্জামান, ইকবাল মাহমুদ ও মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ যুগের অবসান হয়েছে। কিন্তু দুদকের ভাবমূর্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। সর্বশেষ গত ১১ ডিসেম্বর ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের যাত্রা শুরু হয়। ৫ আগস্টের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, অনুসন্ধান ও তদন্তে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটিকে।
সর্বশেষ আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবার, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাবেক শীর্ষ আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ব্যবসায়ী, পুলিশের শীর্ষকর্তাসহ হাজারের বেশি ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছে দুদক। অধিকাংশের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুস গ্রহণ, ব্যাংকের ঋণের অর্থ লোপাট, অর্থ পাচার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি ও বেসরকারি জমি-সম্পত্তি দখল, লুটপাটসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।