
নাম সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তবে এসকে সিনহা নামে পরিচিত বিচারাঙ্গনে। দেশের ২১তম এ প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছিল পদত্যাগ করে। সেইসঙ্গে ছেড়েছেন বাংলাদেশও। এ নিয়ে বইও লিখেছেন সিনহা। তবে অভিযোগ আর বিতর্কের পাল্লাও ছিল বেশ ভারী। যদিও নিজেকে অনেকটা ‘নিরপরাধ’ ভাবেন সাবেক এই প্রধান বিচাপরতি। এমনকি সরকার পরিবর্তনের পর দেশ ছাড়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনাকে নিয়েও ফাঁস করেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। কিন্তু এসকে সিনহা এখন কোথায়? আর দেশেইবা ফিরবেন কবে? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে।
তথ্য বলছে, প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি শপথ নেন সিনহা। বয়স অনুযায়ী তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। কিন্তু মেয়াদের ৮১ দিন আগেই দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছিল তাকে। নানান বিতর্কের মুখে সেই সময় ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। এক পর্যায়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠান বাংলাদেশ দূতাবাসে। ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর এ পদত্যাগপত্র পাঠাতেই তাকে ঘিরে জোর সমালোচনা চলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। ওই সময় বিভিন্ন মামলার দণ্ডও নিতে হয় কাঁধে।
যে কারণে ছাড়তে হয়েছিল বাংলাদেশ
২০১৭ সালের আগস্ট। এ মাসের শুরুতেই প্রকাশিত হয় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়। এর পর থেকেই তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তোপের মুখে পড়েন এসকে সিনহা। সংবিধানের ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা হয়েছিল সংসদের হাতে। কিন্তু রায়ে তা বাতিল করে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনেন সুপ্রিম কোর্ট। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিচারপতি সিনহার জীবনে।
ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আড়াই মাসের টানাপোড়েনের মাঝেই ওই বছরের অক্টোবরে বিদেশে পাড়ি জমান সিনহা। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে ছুটিতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও তা নাকচ করে দেন তৎকালীন বিচার বিভাগের এই অভিভাবক। যাওয়ার সময় অসুস্থ নন, সুস্থ হিসেবেই নিজেকে সাংবাদিকদের জানান দেন তিনি।
নিজের লেখা বইতেও সেসব কথা তুলে ধরেন বিচারপতি সিনহা। এ ছাড়া, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভয়ংকর তথ্য সামনে আনেন তিনি। সিনহার ভাষ্য, ‘গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। আর এ ঘটনায় জড়িত রয়েছেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান সাইফুল আবেদীন।’
তিনি জানান, বাসার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে তাকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেন ডিজিএফআই কর্মকর্তারা। তারা কারও সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলারও সুযোগ দেননি। উল্টো অসুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত চিকিৎসক পাঠানো হতো। এভাবেই অত্যাচার শুরু করেন তারা। হঠাৎ একদিন ডিজিএফআই প্রধান বলে ওঠেন- ‘স্যার আপনি অব্যাহতি দেবেন, আপনি দেশের বাইরে চলে যাবেন।’
সিনহার দাবি, ঋণখেলাপিদের দায় মুক্তি নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর এ বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে গড়ায় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা-বিষয়ক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে। এর পর তাকে নিয়ে শুরু হয় সব ষড়যন্ত্র। একজন সুস্থ প্রধান বিচারপতিকে অসুস্থ বানিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল বলে মনে করছেন অনেকে।
বর্তমানে কানাডায় বসবাসরত এসকে সিনহা বাংলাদেশে ফিরতে চান। চালিয়ে যেতে চান আইনি লড়াইও। যদিও সাবেক এই প্রধান বিচারপতির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডও রয়েছে অনেক। বহুল আলোচিত স্কাইপ কেলেঙ্কারির তালিকায়ও তার নাম রয়েছে।
যেসব রায়ে সায় দেন সিনহা
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ে এসকে সিনহা ছিলেন অন্যতম। ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দেওয়া বেঞ্চেরও সদস্য ছিলেন তিনি। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলীসহ বেশকিছু চূড়ান্ত রায় আসে এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ থেকে। তবে প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর একহাজার ৩০ দিন চেয়ারে ছিলেন তিনি। এ সময়েও বহু আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন এই বিচারপতি।
স্কাইপ বিতর্ক
তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ নিয়ে ২০১২ সালে প্রকাশিত স্কাইপ কথপোকথনে উঠে আসা চরিত্রে আরেক খলনায়কও এই সিনহা। অন্যতম নাটের গুরুও ছিলেন তিনি। নিজের বন্ধু জিয়াউদ্দিনকে স্কাইপ আলোচনায় ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেছিলেন, ‘তিনটাকে দিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছেন এসকে সিনহা। এর পর আপিল বিভাগে নেয়া হবে।’ জবাবে সিনহাকে এই বিচারপতি বলেছেন- ‘যা করার করেন। আগে প্রমোশনটা দেন।’ অর্থাৎ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার দায়ে তিনজনের ফাঁসি দিলে নাসিমকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হবে।
ওই তিনজনের নামও বলা হয়েছিল দীর্ঘ সময়ের সেই স্কাইপ আলোচনায়। তারা হলেন- জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। টার্গেট অনুযায়ী এই তিনজনের বিচারই দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল রায়ের দিকে। দেশ ছাড়ার পর নিজের ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ বইয়ে এ নিয়ে তুলে ধরেন এসকে সিনহা। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময় বিচারক বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রানা দাশগুপ্তকে চট্টগ্রাম থেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু বিচারক বানাতে না পেরে তাকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া, দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনে কিছুটা অনীহা ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে এটি গঠন হলে বিচারকাজ সহজ হবে বলে তাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন তিনি। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়।’
সেই সময় শেখ হাসিনাকে এসকে সিনহা বুঝিয়েছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার বিচারের চেয়েও ট্রাইব্যুনালে বিচার সহজ হবে। কেননা এখানে বইপুস্তক ও পত্রিকা দিয়ে সাক্ষী বানানো যাবে। যা শেখ মুজিবুর রহমানের মামলায় সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া, সেই সময়ে প্রতিটি মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে ফাঁসি কার্যকরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সিনহা। ফলে ‘জুডিশিয়াল কিলিংয়ের অন্যতম কারিগর’ হিসেবে খেতাব পান ভিন্ন ঘরানার আইনজীবীদের কাছে।
প্রধান বিচারপতি থেকে দণ্ডিত আসামি
বিচারাঙ্গনের চূড়া থেকে নামতেই ডজনখানেক অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম হতে থাকেন সিনহা। নিজের নামে প্লট বরাদ্দে প্রভাব বিস্তার, প্লটের মূল্য পরিশোধ না করা, জ্ঞাত আয়বর্হিভূত অর্থের সন্ধান, দুদকের তদন্তে বাধার অভিযোগও উঠতে থাকে। এমনকি জজ নিয়োগে দুর্নীতির কথাও সামনে আসে।
সূত্র বলছে, প্রধান বিচারপতি থাকতে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত তিন কোটি ১৭ লাখ ৮৫ টাকা বিদেশে পাচার করেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ায় থাকা মেয়েদের কাছে এসব অর্থ পাঠান বলে জানা গেছে। মূলত নিজের নামে ব্যাংক হিসাব খুলে ঘনিষ্ঠ লোক দিয়ে মামলার তদবিরের মাধ্যমে এসব অর্থ আয় করেন তিনি। এ ছাড়া, আপিল বিভাগের তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর অপরাধের তদন্ত করছিল দুদক। কিন্তু তদন্তে বাধা হয়ে দাঁড়ান সিনহা। সাবেক এই প্রধান বিচারপতি অনেকটা ঠাণ্ডা মাথার বা বুদ্ধিভিত্তিক দুর্নীতিবাজ ছিলেন বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এক আইনজীবী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ছিলেন অতি ধুরন্ধর। বিচারাঙ্গনে তিনি নানান অনিয়ম করলেও তেমন প্রকাশ পায়নি। বিতর্কিত রায় দেওয়াসহ দুর্নীতিতে ছিলেন অনেকটা এগিয়ে। দেশে থাকলে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিভিন্ন রায় জালিয়াতির কারণে এবিএম খায়রুল হকের মতো তিনি বিচারের আওতায় আসতেন। যদিও এরই মধ্যে কিছু কিছু মামলায় তিনি দণ্ডিত।’ তবে তাকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে দেশ থেকে তাড়ানো উচিত হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।