
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারাটা বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক অগ্রগতি। রপ্তানির ক্ষেত্রে যে ঝুঁঁকিটা ছিল, সেটা এখন মোটামুটি সামাল দেয়া গেছে। কারণ, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ভালো অবস্থানে আছি। তবে বাংলাদেশের জন্য ২০ শতাংশ শুল্ক এখনো বেশি। কেননা, প্রতিযোগীদের সঙ্গে তেমন বড় কোনো পার্থক্য নেই। শুল্ক হ্রাসে ইতিবাচক অগ্রগতি হলেও আত্মতুষ্টির কারণ নেই। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় এ তথ্য জানান অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যদি আমাদের ট্যারিফ ৩৫ শতাংশ আর ভারতের ২৬ শতাংশ হতো তাহলে পরিস্থিতি আমাদের জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে যেতো। তবে এখন দৃশ্যপট বদলেছে। খুবই ইতিবাচক একটা অগ্রগতি। একসময় যেভাবে ভারতের কারণে বাজার হারানোর ভয় ছিল, এখন বরং কিছু অংশ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের উচিত এই সুযোগ কাজে লাগানো। বিশেষ করে, যারা দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ডেলিভারি দিতে পারবে, তারাই সুবিধা পাবে। জাহিদ হোসেন বলেন, যদিও ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হওয়া নিঃসন্দেহে উন্নতি। কিন্তু ২০ শতাংশও বাংলাদেশের জন্য এখনো বেশি। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, আগের মতো ঝুঁকির মধ্যে আর নেই দেশের রপ্তানি খাত। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় এখন আমাদের কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি হয়েছে। তবে শুধু ট্যারিফের কারণে রপ্তানি বেড়ে যাবে এমনটা না। আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো- যেসব মৌলিক সমস্যা আছে, বিশেষ করে সরবরাহ ব্যবস্থার দিক থেকে, সেগুলো ঠিক করতে হবে। তাহলেই আমরা এই সুযোগগুলো বাস্তবে কাজে লাগাতে পারবো। তিনি বলেন, শুল্ক হারে আমরা ভিয়েতনামের কাছাকাছি অবস্থানে আছি, ভিয়েতনাম কিন্তু চীনের ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর আলাদা রেট (শুল্ক সুবিধা) রয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে এমন কোনো কিছু নেই। এই দিক থেকে, ভিয়েতনামের সঙ্গেও আমাদের কিছুটা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা রয়েছে।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পারস্পরিক শুল্ক) হার কমিয়ে ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ। এ সিদ্ধান্ত দেশের রপ্তানি খাতের জন্য সময়োপযোগী। শুক্রবার ফেসবুক পোস্টে সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিযোগী, যেমন ভিয়েতনাম ও ভারতের ক্ষেত্রে ট্যারিফ হার বর্তমানে যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ। ফলে, বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রধান প্রতিযোগীদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সমতুল্য অবস্থানে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ সমন্বয়ের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর যে ঝুঁঁকি বা প্রতিযোগিতামূলক চাপ ছিল, তা কিছুটা কমবে। একইসঙ্গে, রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের বিঘ্নের আশঙ্কাও কমে আসবে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে- চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ হার এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সেলিম রায়হান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুল্ক হ্রাস একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হলেও এটি যেন আত্মতুষ্টির কারণ না হয়। এটি একটি সতর্ক সংকেত, যা বাংলাদেশের বাণিজ্য কৌশলকে আরও শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় ও প্রতিযোগিতামূলক করে গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে গত তিন মাস ধরে আমরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। তবে বাংলাদেশের জন্য এটা স্বস্তিদায়ক। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সমপর্যায়ের কিংবা তার চেয়েও কম ট্যারিফ হার নিশ্চিত হওয়ায় আমাদের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে সরকারকে এখন আমদানি-সংক্রান্ত শর্তসহ যেসব অঙ্গীকার করেছে, তা বাস্তবায়নে কার্যকর ও আন্তরিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা স্বস্তিবোধ করছি যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাকপণ্যের ওপর আরোপিত পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে ২০ শতাংশ এখনো একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে যখন ভিত্তিগত শুল্কসহ মোট কার্যকর শুল্কের হার প্রায় ৩৬ শতাংশে পৌঁছে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের পণ্যে পাল্টা শুল্ক বেশি হলে ব্যবসা কঠিন হয়ে যাবে। তবে প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তানের চেয়ে আমাদের পাল্টা শুল্ক ১ শতাংশ বেশি হলেও ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম। এ ছাড়া চীনের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। এটি আমাদের জন্য বড় স্বস্তির।
স্পারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, আমরা স্বস্তি বোধ করছি যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের ওপর আরোপিত পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে ২০ শতাংশ এখনো একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে যখন ভিত্তিগত শুল্কসহ মোট কার্যকর শুল্কের হার প্রায় ৩৬ শতাংশে পৌঁছে যাচ্ছে।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ভবিষ্যতে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য এই শুল্ক ১৯ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা রক্ষা পেয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের উদ্যোক্তাদের আরও দক্ষ ও সচেতন হতে হবে। ফজলে শামীম এহসান বলেন, আমরা যদি বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারি, তবে ভবিষ্যতে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তরের সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশেষ করে, রপ্তানি বাড়াতে নীতিগত সহায়তা, স্বল্পসুদে ঋণের সুবিধা ব্যবস্থা জরুরি। পাশাপাশি, বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার চাপ ও শর্ত মোকাবিলা করে দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।