
ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন না করাতেই প্রতি বর্ষায় দফায় দফায় ডুবছে চট্টগ্রাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ১৯৯২ সালে প্রণীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। ১৫ বছর ভবিষ্যত্ সময়সীমাকে টার্গেট করে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা চূড়ান্ত মাস্টার প্ল্যানটি চউকের কাছে জমা দিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালে।
এদিকে চলতি বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম মহানগরী ফের দুই দফা ডুবে যাওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে গত প্রায় আট বছরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো খাল-নালা পুনরুদ্ধারে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও কাজের আদৌ অগ্রগতি হয়েছে কি না এ নিয়ে জনমনে প্রবল সংশয় দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ দুইটি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
গত প্রায় আট বছরে প্রকল্পগুলোর কাজে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৮৫২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আট বছর ধরে এসব প্রকল্পের কাজ চললেও এখন পর্যন্ত নতুন খাল খননের পুরো কাজ, অন্তত ১৪টি স্লুইসগেট, ১০টি খালের সংস্কার ও প্রশস্তকরণ, খালের ভেতরে বালু আটকাতে সিল্টট্র্যাপ, নালার নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি বলে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে তথ্য মিলেছে। এই চারটি প্রকল্পের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পটিতে। কর্ণফুলী নদীর তীরে রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণে চউকের আরেকটি প্রকল্পে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৩২৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। সিটি করপোরেশন বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত নতুন খাল খননের কাজে খরচ করেছে ১ হাজার ২৭০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা।
নগরবাসী আগামী বছর বর্ষায় প্রকল্পের পূর্ণ সুফল দেখতে পাবেন বলে চউক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সূত্রগুলো আশাবাদী। কিন্তু গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে যেভাবে দুই দফায় চট্টগ্রাম মহানগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ডুবেছে, বাড়িঘর, দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জনগণকে নৌকায় চড়ে যাতায়াত করতে হয়েছে তাতে নগরবাসীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা ভরসা রাখতে পারছেন না।
‘ফোরাম ফর প্ল্যানড চট্টগ্রাম’-এর সেক্রেটারি বিশিষ্ট স্থপতি জেরিন হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া এবং জলাবদ্ধতা থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোনো দিন মুক্তি আসবে না। চউকে এখনো কোনো ড্রেনেজ বিভাগ ও এক্সপার্ট নেই। সড়ক ব্যবস্থাপনার জন্য ট্রাফিক বিভাগ ও ট্রাফিক এক্সপার্টও নেই। তাহলে পরিকল্পিত নগরায়ন হবে কী করে? তিনি বলেন, ইউএনডিপির অর্থায়নে চট্টগ্রাম মহানগরীর ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের জন্য ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্য ও শ্রীলংকা থেকে এক্সপার্ট বিশেষজ্ঞরা এসেছিলেন। তাতে যুক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও। ১৫ বছর সময়কে সামনে রেখে সেই মাস্টারপ্ল্যানের ডিজাইন করা হয়েছিল কয়েকটি পর্যায়ে। তিনি বলেন, যেখানে সেখানে নিচু জমি, পুকুর ভরাট করে বাড়িঘর তোলা হচ্ছে। পাহাড় কেটে বাসাবাড়ি করা হচ্ছে। যার ফলে ভারী বর্ষণের পর পানি ধারণ করার ক্যাচমেন্ট অঞ্চল আর নেই।
অন্যদিকে, চউকের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস ইত্তেফাককে বলেন, সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি নালায় বৃষ্টির পানিতে ভেসে আসা ভাসমান আবর্জনা ও পাহাড়ধোয়া বালি জমেছিল। আমরা মিটিং করে সেসব পরিষ্কার করার জন্য বলে দিয়েছি। জলাবদ্ধতা বেশি হয় এমন এলাকায় কাজ চলছে। বিভিন্ন এলাকায় খালের প্রশস্ততা বাড়ানো হচ্ছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের নির্দেশে অবাধে পানি চলাচলের জন্য মহানগরীর ৩৩টি ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান, উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্মা।