
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শেষ হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৬৮ দিনের আলোচনা। ১৯টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে- যার কিছুতে রয়েছে ‘নোট অব ডিসেন্ট’। ঐকমত্য ও দ্বিমতের নোট অব ডিসেন্ট নিয়েই তৈরি হচ্ছে ‘জুলাই সনদ’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মতাদর্শের ঊর্ধ্বে ওঠে একসঙ্গে সকল দলের আলোচনার বিষয়টি বিরল। যা দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক বার্তা নিয়ে এলেও এখন বিতর্কের কেন্দ্রে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও আইনি ভিত্তি নিয়ে। কয়েকটি দল স্পষ্টভাবে জানিয়েছে- আইনি ভিত্তি ছাড়া তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও আইনি ভিত্তি নিয়ে কঠোর অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
তারা বলছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এই সরকারের সময়েই করতে হবে এবং সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলেও জানিয়েছে দলগুলো। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসালামী বলছে, আইনি ভিত্তি না থাকলে সনদ মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সেজন্য তারা কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলাও করবে। বিএনপি বলছে, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে দেয়া জাতীয় সনদে খসড়ার প্রতি একমত তারা। পরবর্তী পার্লামেন্ট গঠন করার ২ বছরের মধ্যে তারা সনদ বাস্তবায়ন করবেন। এখানে প্রধান উপদেষ্টা, কমিটির সকল সদস্য ও রাজনৈতিক দল সকলে স্বাক্ষর করবেন। এর চাইতে বড় সম্মতিকে আইনি ভিত্তি না বললে কোনটাকে বলবো? জুলাই ঘোষণাকে সংবিধানের ৪র্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জুলাই সনদ এখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। কিন্তু সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব মৌলিক বিষয়গুলো একত্রিত করে সনদ হয়েছে। আমরা বিভিন্ন মতামত এবং ভিন্নমতসহ সেখানে একমত হয়েছি। আশা করি, সবাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় একমত থাকবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য আমাদের শক্তি হবে।
জুলাই সনদের বিষয়ে তিনি বলেন, জুলাই সনদের খসড়া সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছিল। যে সমস্ত সুপারিশগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবাই গ্রহণ করেছে, সেই সুপারিশগুলো একত্রিত করে জুলাই সনদ প্রণীত হবে। জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার ওপর কোনো আইন নেই। এখানে সবাই একত্রিত হয়ে যে সনদ তৈরি হবে তা আইনের ঊর্ধ্বে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াত মনে করে, সনদের বাস্তবায়ন প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করলে হবে না। আইনি ভিত্তি না থাকলে সনদ মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সেজন্য আমরা কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করবো। আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদে স্বাক্ষর করবে না জামায়াতে ইসলামী।
তাহের বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে এতদিনের বৈঠক খাওয়া-দাওয়া, আর আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকে বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আইনি ভিত্তি দেয়া সম্ভব নয়। এটি ঠিক নয়- কারণ তিনটি পদ্ধতিতে দেয়া যায়। এক লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, গণভোট ও রেফারেন্ডাম।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, শুরু থেকেই বলছি, দু’টি বিষয় স্পষ্ট করতে হবে; মৌলিক সংস্কার কী হবে; দ্বিতীয়ত, এই সংস্কার কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু পদ্ধতিগত আলোচনা না করেই আমাদের হাতে খসড়া ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা এই খসড়ার তীব্র বিরোধিতা করি। তিনি বলেন, এই খসড়ার সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও স্পষ্ট নয়। যদি একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে আমরা এই সনদে স্বাক্ষর করবো না।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচিত সরকার এসে যে এই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে, এর গ্যারান্টি কে দিবে? পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপরই যদি ছেড়ে দেয়া হয় সংস্কার বাস্তবায়ন, তাহলে এতদিনের শ্রম বৃথা। শুধু দলিল আকারে দিলেই হবে না, এর আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন স্পষ্ট করতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সফল হয়েছি। কমিশনের আলোচনায় ১৯টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হয়েছে। আগামী ৫ থেকে ৭ দিনের ভেতর তারা (কমিশন) একটি চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে দেবেন। এরপর হয়তো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আবার দু’একদিন আলোচনা হতে পারে। এখন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়েই সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে, রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে টানা দ্বিতীয়দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন জুলাইযোদ্ধারা। তাদের দাবি- জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং ঘোষণাপত্রকে স্থায়ী আইনি রূপ দিতে হবে।
উল্লেখ্য, প্রথম ধাপে ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ৪৫টি বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। দ্বিতীয় ধাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত ২৩টি বৈঠকে ২০টিরও বেশি মৌলিক বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যায় কমিশন।