
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম। তবে তিনি এখন আর শুধু ডিএনসিসির কর্মকর্তা নন, হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ীও। নিজের পদের প্রভাব খাটিয়ে প্রত্যক্ষভাবে বনে গেছেন ঠিকাদার। বেয়াইয়ের লাইসেন্স ব্যবহার করে ১৩ বছর ধরে ঠিকাদারির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এই সরকারি কর্মকর্তা। এই সময়ে ‘ইউনিম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যশনাল’ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ডিএনসিসিতে করেছে প্রায় ১১ কোটি টাকার অন্তত ২০টি কাজ। এর মধ্যে কারসাজি করে ওই প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার ১৩টি কাজের কার্যাদেশ দেন রফিকুল। ২০১৩ সাল থেকে তিনি একক দরপত্রের মাধ্যমে বেশিরভাগ কাজ নিজেই আহ্বান, মূল্যায়ন ও কার্যাদেশ দিয়েছেন, যা সরকারি ক্রয় বিধিমালা ২০০৮-এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। শুধু তাই নয়, বাগিয়ে নেওয়া এসব কাজ মাঠপর্যায়ে তদারকিও করেছেন এ প্রকৌশলী নিজেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্সে ঠিকাদারির কাজ চলছে ২০১৩ সাল থেকে। দাপ্তরিক নথিপত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জাহিদুল ইসলাম পরশ। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার ভৈরবপুরে। ট্রেড লাইসেন্সে জাহিদুল ইসলাম পরশের বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ আছে রাজধানীর মিরপুরের পীরেরবাগ। পরশ প্রকৌশলী রফিকুলের ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর ভাই, অর্থাৎ সম্পর্কে বেয়াই। ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পেয়ে রফিকুল একক দরপত্র ও কিছু ক্ষেত্রে যোগসাজশপূর্ণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইউনিম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যশনালের নামে বাগিয়ে নেন একাধিক কাজ। চলতি বছরের মার্চে সড়ক বাতির জরুরি মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী সরবরাহে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার কার্যাদেশ। এর আগে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে রফিকুল নিজেই দেন ৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ১২টি কার্যাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউনিম্যাকের লাইসেন্সধারী ব্যক্তি কখনো ডিএনসিসিতে আসেন না; কিন্তু কাজগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। কার্যাদেশগুলো বিক্রি করা হয় আরএম ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স এমআর ট্রেডার্স এবং মেসার্স মুন্না ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাছে।
এমনসব কারসাজির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ডিএনসিসির কয়েকজন প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার বলেন, প্রকৌশলী রফিকুল নিজেই তার বেয়াইয়ের লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার পর সেগুলো অন্য ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করছেন। বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হওয়ার পরে নির্বাহী প্রকৌশলীকে সরিয়ে দিয়েছেন। আর দুজন সহকারী প্রকৌশলীকে নির্বাহী প্রকৌশলী বানিয়ে জালিয়াতি করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর।
বিদ্যুৎ বিভাগের কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, সড়কের বাতি মেরামত ও কিছু আনুষঙ্গিক জরুরি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিগুলোর কাজের পরিধি এবং চূড়ান্ত বিলের অনুমোদন প্রকৌশলী রফিকুল করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পরশ আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তিনি সাধারণত ডিএনসিসিতে কোনো টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেন না। কারণ তিনি ভৈরবে থাকেন। তবে তার লাইসেন্স কিছু ঠিকাদার ব্যবহার করেন। তিনি এর থেকে শুধু লাভের ছোট একটি অংশ পান।’ বেয়াইয়ের লাইসেন্স নিজে ব্যবহার করে ঠিকাদারি করছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তবে ক্রয় বিশেষজ্ঞরা এমন ঘটনাকে পেশাগত অসদাচরণ ও স্বার্থের সংঘাত বলে উল্লেখ করেন।
সরকারি ক্রয় বিধিমালা ২০০৮-এ স্বার্থের সংঘাতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘স্বার্থের সংঘাত মানে এমন কোনো পরিস্থিতি যেখানে একটি সরকারি ক্রয় লেনদেনে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক স্বার্থ একটি ক্রয়কারী সত্তার অর্থনীতি, দক্ষতা, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং টেন্ডার বা প্রস্তাবের সমান আচরণ অর্জনের স্বার্থকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করবে।’
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘যখন একজন প্রকৌশলী একটি টেন্ডারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভূমিকায় জড়িত থাকেন, তখন তার আত্মীয়ের দ্বারা অংশগ্রহণ করা স্বার্থের সংঘাত। তিনি তার বেয়াইয়ের লাইসেন্স ব্যবহার করে প্রতারণাও করেছেন। এই অভিযোগগুলো প্রমাণ করে যে তিনি বহু স্তরের অপরাধে জড়িত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সংস্থাগুলোর এটি তদন্ত করা উচিত।’
ইউনিম্যাককে যেসব কাজ দিয়েছেন রফিকুল: ২০১৩ সালের বিজয় দিবসে কোটেশন পদ্ধতিতে ডিএনসিসির প্রধান কার্যালয় আলোকসজ্জাকরণ কাজটি দেওয়া হয়। পরের বছর ৯০ ওয়াট সম্পূর্ণ সোডিয়াম ফিটিংস, পোল, ব্র্যাকেট, নেট ওয়্যার এবং সুইচ বক্স প্রতিস্থাপন ও স্থাপনের জন্য আরেকটি কার্যাদেশ দেন। অঞ্চল-৪-এর আওতাধীন এলাকায় সড়কে টিউব ও সোডিয়াম বাতির পোল, ব্রাকেট, ফিটিংস, তার, সুইস বক্স ইত্যাদি পরিবর্তন ও নতুন স্থাপন কাজ দেওয়া হয়।
২০১৫ সালে মুজিবনগর দিবসে ডিএনসিসির প্রধান কার্যালয় আলোকসজ্জাকরণ, মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশনের ভাসানটেক প্রধান সড়কে সোডিয়াম বাতি স্থাপন এবং অটিজম সচেতনতা দিবসে নীল বাতি প্রজ্বালনের কাজ দেন। ২০১৬ সালে জোন-৪ এলাকায় সড়কবাতি উন্নয়ন কাজ প্রকল্পের কাজটি দেন রফিকুল। ২০১৭ সালে জোন-২ এলাকায় সড়কবাতির জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারকাজ; বিশেষ করে বিদ্যুতের খুঁটি, যন্ত্রাংশ, বজ্রপাত ও দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা সংস্কারের কার্যাদেশ দেন।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে একক দরপত্রে বেশকিছু কাজ দেন রফিকুল। তার মধ্যে ‘অঞ্চল-৫ এর অধীনে সড়কবাতি, আনুষঙ্গিক সামগ্রী এবং জরুরি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির ভিত্তিতে’ কার্যাদেশ দেন।
যে ঠিকাদারকে কেউ কোনোদিন দেখেননি: ইউনিম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া ২০টি কার্যাদেশের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহিম মিয়া তিনটি এবং সাইফুল ইসলাম দুটি কার্যাদেশ দেন। প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ১৩ বছর ধরে ডিএনসিসির কাজ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু রফিকুল ছাড়া যেসব প্রকৌশলী টেন্ডার আহ্বান করেছিলেন ও বাস্তবায়ন করেছেন তারা কখনো এ ঠিকাদার পরশকে দেখেননি।
কার্যাদেশ দেওয়া প্রকৌশলীদের একজন বলেন, ‘একবার আমি ঠিকাদারকে দেখতে চেয়েছিলাম। কারণ, আমার কিছু কাগজপত্র দরকার ছিল। কিন্তু
দুদিন পর আমাদের কম্পিউটার অপারেটর আলমগীর নথি নিয়ে এলেন। বললেন, তিনি নাকি কোম্পানি থেকে নথি পেয়েছেন।’
রফিকুল ও এ দুই প্রকৌশলী ছাড়াও ২০১৫ সালে তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী অঞ্চল-৩ খন্দকার মাহবুব আলম কোটেশন পদ্ধতিতে একটি সড়কের উন্নয়ন কাজ ইউনিম্যাককে দেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে কর্মরত এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ কোম্পানি সম্পর্কে আমার কোনো তথ্য মনে নেই।’
তবে কম্পিউটার অপারেটর আলমগীর বলেন, তিনি ঠিকাদারের কাছ থেকে কোনো কাগজপত্র গ্রহণ করেননি।
দুজন ঠিকাদার জানান, তারা প্রকৌশলী রফিকুলের কাছ থেকে চুক্তির মোট পরিমাণের ২০ শতাংশের বিনিময়ে কাজ কিনেছেন। আর ব্যাংক চেকে স্বাক্ষর করাতে ইউনিম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক পরশের সঙ্গে দেখা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ঠিকাদার কালবেলাকে বলেন, ‘যদিও পরশ লাইসেন্সের মালিক। তবে আমরা রফিকুল স্যারের কাছ থেকে কাজ কিনি। তিনি চুক্তির মাত্র ২০ শতাংশ দাবি করেন। আমাদের লোকসান হয় না, কারণ স্যার নিজেই কাজের পরিধি মূল্যায়ন করেন ও বিল অনুমোদন করেন। তিনি নিজেই কোম্পানির জন্য কাগজপত্র তৈরি করেন। ডিএনসিসির বিদ্যুৎ বিভাগে সব টেন্ডারে তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।’
ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিগুলো ব্যাপকভাবে যোগসাজশপূর্ণ, কারণ একক দরদাতা হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ কাজ নিয়েছে। সড়কবাতি এবং অন্যান্য কাজের জন্য বার্ষিক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের অন্তত ১৮টি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি টেন্ডারের নথি পাওয়া গেছে, যা ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে আহ্বান ও প্রদান করা হয়েছিল। নথিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাত্র ছয়টি কোম্পানি- ইউনিম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স মুন্না ইঞ্জিনিয়ারিং, মেসার্স এমআর ট্রেডার্স, মেসার্স মদিনা এন্টারপ্রাইজ, এইচ এম হেলাল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড এবং মেসার্স আরএম ইন্টারন্যাশনাল ১৮টি কাজ বাগিয়ে নিয়েছে।
এসব কাজের মধ্যে মুন্না ইঞ্জিনিয়ারিং ছয়টি, এমআর ট্রেডার্স তিনটি, আরএম ইন্টারন্যাশনাল দুটি, মদিনা এন্টারপ্রাইজ দুটি, এইচএম হেলাল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড তিনটি এবং ইউনিম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল দুটি কাজ পেয়েছে। ১৮টি দরপত্রের মধ্যে ৮টিতে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে, ৫টিতে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান, ৪টিতে তিনটি প্রতিষ্ঠান এবং একটি দরপত্রের জন্য চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সাইফুল ইসলাম এবং আবদুর রহিম মিয়া মূলত ডিএনসিসির সহকারী প্রকৌশলী। কিন্তু তাদের পদায়ন করা হয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে। তারা একেকজন ৯টি করে দরপত্র আহ্বান করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জানি না কে এই কারসাজির পেছনে আছেন। তবে আমি এতটুকু বলতে পারি, টেন্ডার মূল্যায়নের সময় আমি সরকারি ক্রয় বিধিমালা-২০০৮ এর কোনো লঙ্ঘন করিনি।’
প্রকৌশলী আবদুর রহিম মিয়াও কারসাজিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েকটি টেন্ডার আহ্বান করেছি। এর আগেও বহু টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে এবং একই প্রক্রিয়ায় কোম্পানিগুলো কাজ পেয়ে আসছে। এমনও হতে পারে, কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মাধ্যমে কারসাজি করে আসছে।’
সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের যোগসাজশে দরপত্রের কার্যাদেশ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, ‘টেন্ডার আহ্বানকারীর আত্মীয়রা ওই টেন্ডারে অংশ নিতে পারবেন না। এটি নিঃসন্দেহে স্বার্থের সংঘাত। টেন্ডার আহ্বানকারী টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব হয়ে থাকেন। তিনি এবং সব মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের এ কথা ঘোষণা করতে হয় যে, টেন্ডার এবং মূল্যায়নকারীদের মধ্যে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সম্পর্ক এবং স্বার্থ নেই।’
আর ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আমরা প্রকৌশলী রফিকুলের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ তদন্ত করব। তিনি দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’