
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন নিয়ে প্রায় তিন দশক পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে প্রত্যাশার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন হতাশা আর সংশয়ের স্রোতে রূপ নিচ্ছে। প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি, নির্বাচন কমিশন গঠনের পরও নির্বাচন কার্যক্রম দৃশ্যমান না হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছাত্রসংগঠনগুলো অভিযোগ তুলেছে—রাকসু নিয়ে চলছে ছলচাতুরী ও দীর্ঘসূত্রতার রাজনীতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ১৯৮৯ সালে সর্বশেষ রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বহুবার আশ্বাস এলেও তা কার্যকর হয়নি। সর্বশেষ দায়িত্ব গ্রহণের পর উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব ৫ মাসের মধ্যে রাকসু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন। গঠিত হয় সাত সদস্যের নির্বাচন কমিশন, দায়িত্ব পান অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেন। কিন্তু সময় গড়ালেও এখনো ঘোষণা হয়নি ভোটার তালিকা কিংবা নির্বাচনী তফসিল।
অতীত থেকে বর্তমান রাকসু রাজনীতি
রাকসু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালে। সর্বশেষ নির্বাচন ১৯৮৯ সালে হলেও নানা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা বন্ধ রয়েছে প্রায় ৩৫ বছর। মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল পূর্ববর্তী স্থগিতাদেশের পেছনে। বর্তমানে প্রশাসনের দিক থেকে ইচ্ছাশক্তি থাকলেও, ছাত্ররাজনীতির বাস্তবতা, পক্ষপাতের অভিযোগ এবং গঠনমূলক সংলাপের অভাব—সব মিলিয়ে রাকসুর বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তার মুখে।
সর্বশেষ ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দাবি হয়ে ওঠে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাবিতে গত ১৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু)-র গঠনতন্ত্র অনুমোদন এবং ২০২৫-২৬ নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে সাত সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এই নির্বাচন কমিশন গঠনের পর শুধু সভা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেনি।
গত ২৩ জুন নির্বাচন কমিশনের মিটিংয়ের খবর শুনে রাকসু ভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন শাখা ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিলে রাকসু কোষাধ্যক্ষের কার্যালয় ঘেরাও করে দাবি আদায়ের হুঁশিয়ারি দেন শাখা সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল। এ সময় তিনি বলেন, রাবি প্রশাসন সর্বপ্রথম রাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু কোনো অদৃশ্য শক্তির বলে তা বাস্তববায়িত হয়নি, আমরা তা জানতে চাই। দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে নকীব প্রশাসনের (উপাচার্য) পদত্যাগের ১ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু হবে।
এদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রফেসর ড. মো. আমজাদ হোসেন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৮ জুলাই সিনেট ভবনে রাকসুর তপশিল ঘোষণা করা হবে। একই দাবিতে এর আগে, ২১ জুলাই প্রশাসনের তালবাহানার প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
ক্ষোভে ফুঁসছে ছাত্রসংগঠনগুলো
রাকসু নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলো এখন একযোগে সরব। কেউ বলছে, প্রশাসনের নিরপেক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। কেউ বলছে, নির্বাচন পেছানোর পেছনে অদৃশ্য শক্তির ইন্ধন রয়েছে।
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল (বাবু) বলেন, আমরা সবসময় রাকসু কার্যকরের দাবিতে সরব ছিলাম, এখনো আছি। প্রশাসনকে শুরুর দিকে আন্তরিক মনে হলেও একটি দলের অযাচিত এবং অযৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন আয়োজনে গড়িমসি করছে। রাকসু নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা যেমন শিক্ষার্থীরা মানবেনা। অন্যদিকে ১০/১২ বছর আগে ছাত্রজীবন শেষ করা বুড়ো/অছাত্রদের নির্বাচনে অনার নাটক মঞ্চায়ন করলে তাও মেনে নেওয়া হবে না।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিরপেক্ষহীন ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে উল্লেখ করে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো পর্যন্ত আমাদের একটি ন্যায্য দাবিও মানেনি এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিরপেক্ষতার ন্যূনতম আস্থাও তৈরি করতে পারেনি। এই প্রশাসন বারবার প্রমাণ করেছে তারা একপক্ষীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। আমরা চাই নির্বাচন—কিন্তু সেই নির্বাচন হতে হবে এমন, যেখানে সব ছাত্র সংগঠন সমান সুযোগ পাবে, প্রশাসন থাকবে নিরপেক্ষ এবং শিক্ষার্থীরা থাকবে নিরাপদ ও আস্থাশীল। অন্যথায়, এ নির্বাচন হবে কেবল একটি নিছক নাটক—যা গণতন্ত্রের অপমান এবং শিক্ষার্থীদের বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই নয়।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল বলেন, রাকসু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের একটি প্লাটফর্ম। অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে এ ব্যাপারে আমরা একমত। প্রশাসনের গাফিলতির কারণে রাকসু নির্বাচন হচ্ছে না। প্রশাসনের প্রতি আমাদের দাবি যেন দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রস্তুতিতে লাগছে সময়, বলছে প্রশাসন
অভিযোগের বিপরীতে প্রশাসন বলছে—একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে তারা চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রফেসর ড. মো. আমজাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে রাকসু নির্বাচন হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই একধরনের জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। সেটা দূর করতে হবে। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন হঠাৎ একটি নির্বাচনের তারিখ দিয়ে দিতে পারে না। একটা প্রস্তুতি আছে। সেই সময়টাই আমরা নিয়েছি। ২৮ জুলাই সব অংশীদারদের সহযোগিতা থাকলে একটা তারিখ হয়ে যাবে বলে আশা করছি। আমাদের কোনো চেষ্টার ত্রুটি নেই। এবারের রাকসু একটা ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে।
রাকসুর সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতিদিনই নতুন নতুন বিষয় সামনে আসছে। সেগুলোকে এডজাস্ট করেই আমাদের এগুতে হচ্ছে। এতে করে একটা দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিলম্ব তৈরি হচ্ছে। এ জট খুলতে খুলতেই আমরা এগোচ্ছি।’
এখন ক্যাম্পাসজুড়ে শিক্ষার্থীদের মনে শুধু একটাই জিজ্ঞাসা রাকসু কী আবারও পিছিয়ে যাবে? নাকি চলমান চাপ এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে ভাঙবে দীর্ঘ তিন দশকের অচলাবস্থা। এর জবাব মিলবে আগামী ২৮ জুলাইয়ের তপশিল ঘোষণায়।