
বিকাশ বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় মোবাইল আর্থিক পরিষেবা (এমএফএস) সংস্থা। এটি মূলত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন, বিল পরিশোধ, কেনাকাটা এবং অন্যান্য আর্থিক পরিষেবা সরবরাহ করে। ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি-এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি পরিচালিত হয়। এই বিকাশ-এর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে অনেক আগে থেকেই। বিকাশ যেহেতু ব্র্যাক এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বরাবরই অত্যন্ত প্রভাবশালী তাই এর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও নানাভাবে এসব অভিযোগকে ধামাচাপা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদেশে অর্থপাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়গুলো তদন্ত করা এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অভিযোগ রয়েছে যে, এই বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারাই বরাবর বিকাশ-কে মানি লন্ডারিংয়ে প্রশ্রয় এমনকি সহযোগিতাও দিয়ে এসেছে। আর সেই অভিযোগটির এবার হাতেনাতে প্রমাণ দিলেন স্বয়ং বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারা নিজেরাই অতি গোপনে বিকাশ’র আতিথেয়তায় প্রমোদ ভ্রমণে গিয়ে।
কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে প্রমোদ ভ্রমণে গেলেও এবং তাৎক্ষণিকভাবে ধরা না পড়লেও পরবর্তীতে ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট ১১ জন কর্মকর্তা ওই প্রমোদ ভ্রমণে যান। এরা সবাই বিএফআইইউ’র। বিএফআইইউ’র প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম এতে নেতৃত্ব দেন। দু’দিনের এ প্রমোদ ভ্রমণটি হয় গত মে মাসে সিলেটে। ভ্রমণের যাতায়াতসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা ছাড়াও বিকাশ কর্তৃপক্ষ ১১ জন বিএফআইইউ কর্মকর্তার প্রত্যেককে নগদ ডলার-এর আকর্ষণীয় উপহারও দিয়েছেন, দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা যায়, প্রত্যেকেরই কমিটমেন্ট ছিল কোনো ক্রমেই যাতে এ ঘটনা ফাঁস না হয়- এ ব্যাপারে তারা অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন। ১১ জনের বাইরে এ বিষয়ে কারো সঙ্গে কোনো কথা শেয়ার করবেন না। কিন্তু কীভাবে যেন এক কান দু’কান হয়ে ঘটনা একেবারে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে তলব করা হয় এ এফ এম শাহীনুল ইসলামকে। এবং এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরকেও তলব করা হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। তিনি বিষয়টি জানেনও না। এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারেননি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআই পুরো এই বিষয়টি তদন্ত করছে।
সরকারের নিয়ম অনুযায়ী অফিসিয়াল অনুমতি ব্যতিত স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের আতিথেয়তায় কোথাও যেতে পারেন না সরকারি কর্মকর্তারা। বিকাশের এ বিষয়টি আরো ভিন্নতর এবং গুরুতরও বটে। যেখানে বিকাশের বিরুদ্ধে রয়েছে অর্থপাচারের অসংখ্য অভিযোগ। এবং এসব অভিযোগ তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে বিএফআইইউ। সেই বিএফআইইউ’র প্রধানের নেতৃত্ব একসঙ্গে ১১ জন কর্মকর্তা বিকাশের আতিথেয়তায় গোপনে প্রমোদ ভ্রমণে গেলেন! এই কর্মকর্তারা, বিশেষ করে প্রধান পদে যিনি আছেন এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম দুর্নীতি এবং সরকারের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে কতটা বেপরোয়া তারই প্রমাণ পাওয়া যায় এই ঘটনা থেকে।
বিএফআইইউ’র প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম শুধু এখন যে নিজের বেপরোয়া দুর্নীতির প্রমাণ দিলেন তা নয়, চাকরিজীবনে তিনি বরাবরই একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ আমলে বিএফআইইউ’র উপপ্রধান পদে থেকে ব্যাপকভাবে অর্থপাচারে সহযোগিতা করেছেন বলে প্রমাণাদি রয়েছে। আওয়ামী আমলে অর্থপাচারকারী সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন তিনি। তারই সহযোগিতায় বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের শেষার্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে প্রমাণাদি রয়েছে। সংস্থাটির প্রধান পদে তখন ছিলেন মাসুদ বিশ্বাস। এই মাসুদ বিশ্বাসের সহযোগী হিসেবেই শাহীনুল ইসলাম অর্থপাচারে জড়িত ছিলেন। শাহীনুল ইসলামের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যায় ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩। অবসরের আগ পর্যন্ত শাহীনুল ইসলাম বিএফআইইউ’র উপপ্রধান পদে থেকে অর্থপাচারে মাসুদ বিশ্বাসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন।
নির্বাচনের আগ মুহূর্তে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ওই সময়ই সবচেয়ে ব্যাপক হারে অর্থপাচার হয়। কিন্তু মাসুদ বিশ্বাস কারাগারে থাকলেও শাহীনুল বিএফআইইউ’র প্রধান পদে বসার সুযোগ পেয়েছেন এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই। এমনকি নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করার পরও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে তাকে এই পদে বসানো হয় সরকারের প্রভাবশালী মহলের তদবিরে। যদিও অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এতে মোটেই সায় ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সার-সংক্ষেপের তোয়াক্কা না করেই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয় বিএফআইইউ’র প্রধান পদে এ এফ এম শাহীনুল ইসলামকে।
জানা যায়, এই শাহীনুল ইসলামকে বিএফআইইউ’র প্রধান করার পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগেরই। জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং মির্জা আজম ছিলেন শাহীনুলের একান্ত কাছের। তাছাড়া অর্থপাচারকারী গ্রুপটিও চাচ্ছিল বিএফআইইউ’র প্রধান হিসেবে শাহীনুল ইসলামকে। আওয়ামী লীগ আমলে এ ব্যাপারে অলিখিত সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, তখনকার বিএফআইইউ’র প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের চাকরির মেয়াদ শেষ হলেই শাহীনুলকে গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থাটির প্রধান করা হবে। অর্থপাচারে অন্যতম সহযোগী, বিএফআইইউ’র প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ৫ আগস্টের পরে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি গ্রেফতার হন এবং বর্তমানে কারাগারে আছেন। ওই মাসুদ বিশ্বাসেরই অন্যতম সহযোগী শাহীনুল ইসলাম এখন বিএফআইইউ’র প্রধান।
উল্লেখ্য, বিএফআইইউ’র প্রধান পদে নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করেন তিনি। শুধু ফেল-ই নয়, এতোটা খারাপ করেন যে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেয়া নিয়োগ পরীক্ষায় মাঝপথে তার পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছিল। কারণ, তিনি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিলেন না। আর সেই ব্যক্তিকেই এনে বসানো হয়েছে বিএফআইইউ’র প্রধান পদে। চেয়ারে বসার পর থেকেই অর্থপাচারকারীদের স্বার্থরক্ষায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন। বিএফআইইউ’র প্রধান পদে বসেই শাহীনুল ইসলাম অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ এবং পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া থামিয়ে দিয়েছেন। এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম অধীন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার কার্যক্রমে উদ্যোগী হয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য। ক্রমান্বয়ে শাহীনুল ইসলাম বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যে গোপনে বিকাশের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রমোদ ভ্রমণে যেতেও আগপাছ ভাবেননি। আর এতটা বেপরোয়া হতে গিয়েই অবশেষে ধরা খেলেন।
শীর্ষনিউজ