Image description

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান শুল্ক সংকট সমাধানে আশাবাদের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। আসছে ২৯ জুলাই দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, এর আগেই ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে শুল্ক হ্রাসের বিষয়ে ‘সুখবর’ আসতে পারে বলে আভাস মিলেছে।

গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও চামড়াজাত পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার প্রস্তুতি চলছে, যা আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে পারে। তবে চলমান কূটনৈতিক তৎপরতা ও বাণিজ্য আলোচনার ইতিবাচক অগ্রগতিতে শুল্কহার ১৮ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

সবার নজর এখন ২৯ জুলাইয়ের দিকে

এই মুহূর্তে দেশের রফতানিকারক, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, শ্রমিক, ও আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত সব পক্ষের চোখ এখন ২৯ জুলাইয়ের ভার্চুয়াল বৈঠকের দিকে।

বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ১৮-২০ শতাংশে আনার ঘোষণা দেয়, তাহলে তা হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় বিজয়। এমনকি এটি শুধু একটি শুল্ক সংকট নয়, বরং দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সক্ষমতারও একটি বড় পরীক্ষা।

অনুষ্ঠেয় ওই বৈঠক সফল হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়া ও অন্যান্য রফতানি খাত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার নতুন সুযোগ পাবে। অন্যথায়, বড় ধরনের আর্থিক ও সামাজিক ধাক্কা লাগতে পারে দেশের অর্থনীতিতে।

 বাংলাদেশের জন্য বড় ধাক্কা

গত ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো এক আনুষ্ঠানিক চিঠিতে আগামী ১ আগস্ট থেকে নতুন শুল্কহার কার্যকর করার ঘোষণা দেন। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর গড় শুল্কহার বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশে পৌঁছাবে।

এই বাড়তি শুল্ক সরাসরি প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প ও চামড়াজাত পণ্যের ওপর। বাড়বে পণ্যের দাম, কমবে প্রতিযোগিতা, এবং ঝুঁকিতে পড়বে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেই বাংলাদেশ সরকার শুরু করে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে  সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নিরলস কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রচেষ্টায় এখন আশার আলো দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে, ২৯ জুলাইয়ের বৈঠকের আগেই যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক হ্রাসের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে। যদি তা হয়, তবে দেশের রফতানি বাণিজ্য একটি বড় সংকট থেকে মুক্তি পাবে।

শুল্ক আলোচনায় অগ্রগতি

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে— ২৯ জুলাই একটি ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি বৈঠকের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে সরকার আশা করছে— এই ভার্চুয়াল বৈঠকের আগেই ওয়াশিংটন থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে।

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা আশাবাদী, ২৯ জুলাইয়ের আগেই যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারে। বিগত বৈঠকগুলোতে আমরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ও প্রস্তাব উপস্থাপন করেছি এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, তা মার্কিন প্রশাসনের কাছে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।”

বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের উদ্যোগ

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য আনতে বাংলাদেশ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, সয়াবিন, তুলা ও বিমান আমদানির পরিকল্পনা। ইতোমধ্যেই গম কেনার একটি চুক্তি হয়েছে। তুলা আমদানির পর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মিরসরাই ইপিজেডে ৬০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে ২৫টি বিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।

মেধাস্বত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপ

শুল্ক আলোচনায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস’ (আইপিআর) বা মেধাস্বত্ব অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, বাংলাদেশে এখনও মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের প্রবণতা রয়েছে, যা মার্কিন বিনিয়োগকারী ও শ্রমিকদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পোশাক, ভোগ্যপণ্য, চলচ্চিত্র, ওষুধ ও সফটওয়্যারে নকল পণ্যের সরবরাহ বাড়ছে বলে অভিযোগ করেছে তারা।

বিশ্বে নকল পোশাক উৎপাদক দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশকে শীর্ষ পাঁচে রেখেছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর)। যদিও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ‘অগ্রাধিকার নজরদারির তালিকায়’ নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশ মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের আইন আরও শক্তিশালী করুক এবং তার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করুক।

আইনি কাঠামো ও চুক্তি সইয়ের আহ্বান

যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ১৩টি কনভেনশন ও চুক্তিতে সই করুক এবং সেগুলোর আলোকে নিজস্ব আইনি কাঠামো শক্তিশালী করুক। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ট্রিপস (টিআরআইপিএস), প্যারিস কনভেনশন, ডব্লিউআইপিও-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কাঠামোতে সংযুক্ত হলেও আইনের বাস্তব প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এছাড়া মার্কিন পক্ষ থেকে আরও ১১টি অতিরিক্ত শর্ত দেওয়া হয়েছে— এগুলোর মধ্যে রয়েছে মার্কিন পণ্যের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং নকল পণ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।

প্রতিনিধিদলের তৎপরতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দুই দফায় প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতিনিধি দলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন খাতের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। তারা ওয়াশিংটনে ইউএসটিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমরা আশাবাদী, আলোচনায় ভালো ফলাফল আসবে। ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমেই হয়তো সরাসরি বৈঠকেরও প্রস্তাব আসতে পারে। আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষাই সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার। শুল্ক কমানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং এখনও সুযোগ রয়েছে আরও আলোচনার।”

তিনি বলেন, “সরকার কোনও লবিস্ট নিয়োগ করেনি। ব্যবসায়ীরা চাইলে তা করতে পারেন। তবে এখানে যে কাঠামোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে— জাতীয় জরুরি অবস্থা (ন্যাশনাল ইমারজেন্সি)— সেই কাঠামোয় লবিস্টদের তেমন ভূমিকা থাকবে কিনা, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।”

বশিরউদ্দীন আরও বলেন, “এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের দেশে নানা রকম আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে, যা কেবল বাংলাদেশই বোঝে। এই পরিবর্তনগুলো আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে আনতে হয়, যেখানে লবিস্টদের বিশেষ কিছু করার সুযোগ খুব সীমিত। এ ধরনের আইনি ও নীতিগত প্রক্রিয়াগুলো একজন লবিস্টের পক্ষে বোঝা কঠিন।”

তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কহার কার্যকরের সময় খুবই ঘনিয়ে এসেছে— মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। এই অল্প সময়ের মধ্যে আলোচনা শুরুর সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি সাংবাদিকদের মতোই আগ্রহী। আপনারা যতটা আগ্রহ নিয়ে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন, আমিও ঠিক ততটাই উৎসুক। তবে বিষয়গুলো দ্রুত এগোচ্ছে। আমরা হয়তো আজ-কালকের মধ্যে একটি অনলাইন বৈঠকের সিডিউল পেতে যাচ্ছি।”

শেখ বশিরউদ্দীন আরও বলেন, “গত ১৫ দিন ধরে আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যায়ে দিনরাত কাজ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের অবস্থান বিস্তারিতভাবে জানানো হয়েছে। যদি ওদের তরফ থেকে কোনও আমন্ত্রণ আসে, আমরা প্রস্তুত আছি অংশগ্রহণের জন্য।”

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, অনলাইন বৈঠকের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নির্ধারণ করা হবে এবং বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় বার্তা দিতে সক্ষম হবে।