
আকাঙ্খা ছিল স্বপ্নের দেশ ইতালিতে যাবে ওরা। অভাব থাকবে না পরিবারের সুদিন আসবে ফিরবে। তবে আকাঙ্খা পূরণ তো দূরের কথা, এখন খোঁজ মিলছে না মাদারীপুর জেলা জেলার ১৫ যুবকের। এর মধ্যে রাজৈর উপজেলার ১৪ যুবক ও মাদারীপুর সদর উপজেলার এক যুবকের। গত পাঁচ মাস ধরে রাজৈর উপজেলার ১৪ যুবকের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। খোঁজ মেলেনি দেড়বছরেও মাদারীপুর সদর উপজেলার এক যুবকের।
নিখোঁজরা হলেন- মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের চৌরাশী গ্রামের মোসলেম শিকদারের ছেলে বাবুল শিকদার, মজিবর বয়াতীর ছেলে সাজ্জাদ বয়াতী, জাকির মাতুব্বরের ছেলে বাদল মাতুব্বর, কানাই রায়ের ছেলে লিটন রায়, নিরঞ্জন বাড়ৈর ছেলে বাঁধন বাড়ৈ, কিসমদ্দি বাজিতপুর গ্রামের আলম চৌকিদারের ছেলে ইমন চৌকিদার, অহিদুল মাতুব্বরের ছেলে নয়ন মাতুব্বর, আজিজ খালাসীর ছেলে খলিল খালাসী, সোনা মিয়া চৌকিদারের ছেলে সোহেল চৌকিদার, নয়াকান্দি বাজিতপুর গ্রামের গৌরাঙ্গ বাড়ৈর ছেলে গৌতম বাড়ৈ, সামচু সরদারের ছেলে ইমরান সরদার, শ্রীনাথদী বাজিতপুরের জলিল বয়াতীর ছেলে আল আমিন বয়াতী, শ্রীনদী গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান ঘরামীর ছেলে আলী ঘরামী ও পাখুল্লা গ্রামের জাহাঙ্গীর বেপারীর ছেলে সালমান বেপারী এবং মাদারীপুর সদর উপজেলার সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের ত্রিভাগদী গ্রামের রহিম হাওলাদারের ছেলে সাজাহান হাওলাদার। এদের সবার বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা সবাই অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালি যেতে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর তারা কয়েকটি দেশ ঘুরে লিবিয়ায় অবস্থান নেন। লিবিয়ায় গেলে সেখানে তারা দালাল ও মাফিয়াদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। তাদের বিভিন্ন জায়গায় বন্দি করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়। এই ১৪ পরিবারের প্রায় সবাই চড়া সুদে ঋণ নিয়ে, কেউবা জমি বিক্রি করে দালালদের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের সাধুর আশ্রম এলাকার মৃত আয়নাল হাওলাদারের ছেলে দালাল বাবুল হাওলাদার এ ঘটনায় জড়িত। অন্যরা হলেন বাবুল হাওলাদারের মেয়ে সোনিয়া আক্তার ও শশি আক্তার এবং বাবুল হাওলাদারের স্ত্রী চুন্নু বেগম। টাকা নেয়ার পর থেকে গত কয়েক মাস ধরে ঘরে তালা ঝুলিয়ে তারা পলাতক।
বাবুল দালাল ও তার পরিবারের লোকজন প্রথমে ১৪ লাখ, পরে ১২ লাখ সবশেষ পাঁচ লাখ টাকা নেয়। লোন করে ও জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। সংসারে আমার তিন মেয়ে আছে। আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। লোনের টাকাও দিতে পারছি না। এদিকে আমার স্বামীর কোনো খোঁজ নেই। আমরা এখন কী করবো বুঝতে পারছি না।’
স্থানীয় ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো সূত্রে জানা গেছে, দালাল বাবুল হাওলাদার প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে প্রথম ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নেন। পরে ইতালি প্রত্যাশীদের লিবিয়ায় বন্দি করা হয়। এরপর নির্যাতন চালিয়ে জনপ্রতি আরো ২৫-৪০ লাখ টাকা নেয়া হয়। এরপরও ওই যুবকদের খোঁজ নেই।
নিখোঁজ সোহেল চৌকিদারের স্ত্রী রুনা বেগম বলেন, ‘বাবুল দালাল ও তার পরিবারের লোকজন প্রথমে ১৪ লাখ, পরে ১২ লাখ সবশেষ পাঁচ লাখ টাকা নেয়। লোন করে ও জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। সংসারে আমার তিন মেয়ে আছে। আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। লোনের টাকাও দিতে পারছি না। এদিকে আমার স্বামীর কোনো খোঁজ নেই। আমরা এখন কী করবো বুঝতে পারছি না।’
নিখোঁজ লিটনের বাবা কানাই রায় বলেন, ‘বাবুল ও তার স্ত্রী এবং তার দুই মেয়ের হাতে ৫৫ লাখ টাকা দিয়েছি। জমি বিক্রি করেছি। সুদে টাকা এনেছি। এখন সুদের টাকাও দিতে পারছি না, জমিও নেই। তাই কী করবো? আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি।’
কথা হয় প্রতিবেশী গৌতম রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লিটনের কোনো খোঁজ নেই। তার বাবা জমি বিক্রি করে ও লোন করে দালালদের টাকা দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
এদিকে অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে দেড় বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন মাদারীপুরের শাজাহান হাওলাদার (৩০)। পরিবারের লোকজন দফায় দফায় ৩৮ লাখ টাকা দিলেও ইতালি যাওয়া হয়নি তার। বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন সেটাও জানে না তার পরিবার।
মাদারীপুর সদর উপজেলার নিখোঁজ যুবক শাজাহান হাওলাদারের পারিবারিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শাজাহান হাওলাদারকে ইতালি যাওয়ার প্রলোভন দেখান প্রতিবেশী মৃত বারেক বেপারীর ছেলে দালাল আমির বেপারী। আমির বেপারী সরাসরি ইতালি নেয়ার কথা বলে শাজাহানের পরিবারের কাছ থেকে প্রথমে ১০ লাখ টাকা নেন। এরপর ২০২২ সালের ২ জুলাই শাজাহানের পাসপোর্ট নিয়ে তাকে প্রথমে পাঠানো হয় দুবাই। পরে মিশর ও সবশেষ শাজাহানকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে তাকে জিম্মি করে লিবিয়ার মাফিয়ারা। শাজাহানের ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। এরপর পরিবারের কাছ থেকে দালাল চক্র দফায় দফায় ৩৮ লাখ টাকা নেয়।
২০২৪ সালের ২১ মার্চের পর থেকে আর কোনো সন্ধান মেলেনি শাজাহানের। তিনি বেঁচে আছেন কি না তাও জানে না তার পরিবার। পরে বাধ্য হয়ে মাদারীপুরের আদালতে ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর একটি মানবপাচার আইনে মামলা করে শাজাহানের পরিবার।
নিখোঁজের বাবা রহিম হাওলাদার বলেন, আমার ছেলেকে ইতালি নেয়ার কথার বলে লিবিয়ায় বন্দি করে রাখে দালাল আমির ও তার লোকজন। পরে তাকে নির্যাতন করা হয়। এরপর আমাদের ভয় দেখিয়ে কয়েক দফায় মোট ৩৮ লাখ টাকা নেয়। এতগুলো টাকা দেয়ার পর আজ দেড়বছর ধরে ছেলের কোনো খোঁজ নেই। আমার ছেলেকে ফেরত চাই আর দালাল আমির বেপারীর শাস্তি চাই।
অভিযুক্ত আমির বেপারী বলেন, আমি শাজাহান নামে কাউকে চিনি না। তাকে কে বা কারা কোথায় নিয়ে গেছে আমি তা জানিও না। আমার নামে তিনি মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছেন।
স্থানীয় জাগো উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ফারজানা আক্তার বলেন, ‘মাদারীপুরের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তারা তাদের সন্তানদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়া দিয়ে ইতালি পাঠান। সন্তানদের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও উন্নত জীবনের আশায় এই পথ বেছে নেন। এগুলো বন্ধের ব্যাপারে অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে। দালালদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা দেশগ্রামের নির্বাহী পরিচালক এবিএম বজলুর রহমান বলেন, ‘মাদারীপুরের বহু সন্তান লিবিয়ায় সমুদ্র ডুবে, দালালদের নির্যাতনে মারা গেছে। তবুও যাওয়া বন্ধ হচ্ছে না। তাই এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি দালালদের ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হাছান বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের পরিবার থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।