Image description

উত্তরাঞ্চলের দুঃখ বলে খ্যাত প্রমত্তা তিস্তাকে নিয়ে এবার স্বপ্নের জাল বুনছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। তিস্তা নদীর পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা ও জীববৈচিত্র রক্ষায় ‘তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনঃরুদ্ধার প্রকল্প’ বাস্তবায়নের উপর জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এতদিন বাংলাদেশকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে চাপে রেখেছিল ভারত। তবে এখন ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের মোড় ঘুরেছে। 

গত ৫ আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে অনেক সমীকরণ বদলে যেতে শুরু করেছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতের প্রভাবকে উপেক্ষা করে চীনকে দিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাতে যাচ্ছে। 

সম্প্রতি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে তিস্তা নদী পরিদর্শন করেছে চীনা প্রতিনিধিদল। তারা নদীভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে দেখেন এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত কাজ শুরুর ইংগিত দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি উত্তরাঞ্চল সফরে এসে তিস্তা নদীতীর রক্ষায় চলমান কাজ পরিদর্শনে গিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আগামী অক্টোবরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনার ডিজাইন চূড়ান্ত হবে। 

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের খবর এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে। এতে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন তিস্তা পাড়ের কৃষক-জনতা। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের চাষাবাদে আসবে নতুন চাঞ্চল্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে বিরূপ প্রভাব থেকে। শুধু তাই নয়, তিস্তা ফিরে পাবে তার পুরনো দিনের খরস্রোতার চিরচেনা রূপ। 

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাপেরমুখে তিস্তা পানি চুক্তি ২০১১ সালে বাস্তবায়নের পথে বাধাগ্রস্ত হয়। সেই সময় হতে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা পানি চুক্তি বাস্তবায়নের চিন্তার পাশাপাশি তিস্তা নিয়ে বিকল্প চিন্তা শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। ২০২১ সালে তিস্তা মহা পরিকল্পনা এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। একই বছর মার্চে বাংলাদেশকে চীনা প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন জমা দেয়। দ্রুত তিস্তা প্রকল্প শুরু করতে আগ্রহী তারা। বিনিয়োগেরও আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি। নড়েচড়ে বসে ভারত সরকার। ভারত ও চীনের জন্য ভৌগলিক অবস্থানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডর ( চীকেন নেক)। এই ভৌগলিক অবস্থানে পাশ দিয়ে তিস্তা প্রবহমান। তিস্তা মহা-পরিকল্পনায় চীনা অর্থ বিনিয়োগ ও চীনের তত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টি ভারত তাদের দেশের জন্য নিরাপদ মনে না করার কারনে তারা প্রকল্পটির বিপক্ষে অবস্থান নেন। 

তিস্তা নদীতে বাংলাদেশ অংশে একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণের জন্য চীন যে তৎপরতা নিয়েছে, সেটি আটকে আছে ভারতের আপত্তির কারণে। ১৯৭৫ সালে ভারত তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি জেলার গজল ডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ন্যায্য হিসার কোন পানি না দিয়ে ধীরে ধীরে মরুভূমিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। কিন্তু তিস্তা নিয়ে ভারতের দাদাগিরি শেষ হতে চলেছে। 

এর আগে চলতি বছরের (১১ মার্চ) তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় করে প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নেয় পাওয়ার চায়না ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ সময় পাওয়ার চায়নার সিনিয়র এক্সপার্টরা জানান, ‘তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনঃরুদ্ধার প্রকল্প’ এর মাধ্যমে উত্তরের ৫ জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ১১০ কিলোমিটার নদীতে ১ হাজার ৩৩০ লক্ষ ঘনমিটার ড্রেজিং করা হবে। 

পুরো নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজ, নদীর দু’ধারে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ, ৬৭টি গ্রোয়েনবা স্পার নির্মাণ ও মেরামত কাজ, নদীর দু’ধারে রোড নির্মাণ কাজ, ১৭০ দশমিক ৮৭ বর্গ কিলোমিটার ভূমি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়নকাজ এবং পরিবেশগত ও সামাজিক সুরক্ষা কাজ করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গ্রোয়েন নির্মাণ ও তীর প্রতিক্ষার কারণে নদী ভাঙ্গন রোধ হবে, বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজের মাধ্যমে বন্যা ঝুঁকি হ্রাস হবে, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও নদী পুনরুদ্ধার হবে। 

খনন কৃত মাটি ভরাট করে নদীর তীরবর্তী ভুমি পুনরুদ্ধার করে উক্ত জমির উপর অর্থনৈতিক অঞ্চল, পাওয়ার প্লান্ট, স্যাটেলাইট টাউন নির্মাণ, সেচ ও কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা, শুস্ক মৌসুমে সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য বর্ষা কালে শাখা নদীসহ ব্যারেজের উজানে তিস্তা নদীতে প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণ করা এবং শুস্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণ করে প্রকল্প এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নদী পাড়ের ১১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পাবে। 

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের এমন উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ। তারা বলছেন, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে চরম হুমকিতে পড়েছে তিস্তা অববাহিকার দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকা। এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দীর্ঘ সময় ধরে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা আন্দোলন গড়ে তুলে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি তুলে। তাই প্রত্যাশা ভূ-রাজনৈতিক দ্বৈরথ কাটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, তিস্তা নদীপাড়ের বাসিন্দাদের ভাবনা চিন্তা গুরুত্ব পাবে এই মহাপরিকল্পনায়। তিস্তা তীরবর্তী কৃষক রাজু মিয়া, মকবুল হোসেন, তসর উদ্দিনসহ অনেকেই জানান,শুস্ত মৌসুমে যখন পানির জন্য হাহাকার অবস্থ তখন ভারতের এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের কারনে কোনো চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। যে সব ফসল আবাদ করা হয় তা বেশিরভাগ শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে। যার ফলে সেচ দিতে গুনতে হয় বাড়তি খরচ। আর বর্ষা মৌসুমে পানি ভারত নিয়ন্ত্রিত গজলডোবা ব্যারেজ থেকে পানি ছেড়ে দিয়ে ভাসিয়ে দেয় তিস্তাপাড়ের মানুষকে।এই হলো তাদের নীতি। 

‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ সংগ্রাম পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকও সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, তিস্তা মেগা প্রকল্প এবং চুক্তি বাস্তবায়ন এখন গনদাবীতে পরিনত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এটি বাস্তবায়ন হলে নদীপাড়ের ২ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ভয়াবহ হুমকি থেকে রক্ষা পাবে। আর দিল্লির তাঁবেদারী নয়, তিস্তা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাই ছিল আমাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী জানান, তিস্তা মহা পরিকল্পনা উত্তরাঞ্চলবাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। লালমনিরহাট চেম্বার অব কমাসের সভাপতি এস.এ হামিদ বাবু বলেন,‘তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে দুই তীরে হাজার হাজার একর আবাদি জমি উদ্ধার হবে। বন্যা থেকে কৃষি ও কৃষক রেহাই পাবে। আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং দ্রুত বাস্তবায়নের দাবী করছি। 

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনিল কুমার রায় বলেন, তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইটসহ নির্মাণ ছাড়াও নদী খনন, নদী শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং আধুনিক সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। এছাড়া, মাছ চাষ, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা এবং বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলেও জানান তিনি। 

তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দাবিতে চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। যা ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে তিস্তা নদীরক্ষা আন্দোলনের নেতারা এ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল। ১১টি পয়েন্টে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে ১১৫ কিলোমিটার তিস্তা নদীর তীরে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়েছিল। এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কর্মসূচির শেষ দিন লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালী যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়েছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

শীর্ষনিউজ