
রাষ্ট্র সংস্কারে মৌলিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না হলে সিদ্ধান্ত জানাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরই মধ্যে সে উদাহরণ তৈরি হয়েছে। বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। কোনো কোনো দল এ ধরনের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করছেন। আবার কোনো দল কমিশনের পরবর্তী বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে।
তারা বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। এ কমিশন জনগণের একক কোনো দলের নয়। কিন্তু কমিশন একটি-দুটি দলের হয়ে কাজ করছে। তাদের দিকে হেলে পড়ছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এভাবে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। কমিশন যদি সিদ্ধান্ত জানিয়ে থাকে তাহলে দিনের পর দিন এ আলোচনার অর্থ কী? তাদের বক্তব্য- যেসব ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হবে না সেগুলো বাদ যাবে। আর যেগুলোতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হবে সেগুলোই জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কমিশন যে ভূমিকা পালন করছে তা অনেকটা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন কি না সে বিষয়ে একমত হতে ব্যর্থ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। পরে কমিশনের পক্ষ থেকে এনিয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলা হয়েছে- প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না। কমিশনের এ ধরনের সিদ্ধান্তে সরাসরি অসন্তোষ জানিয়েছে বিএনপি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের এক সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আমাদের এ সিদ্ধান্ত অনেকটা টেস্ট কেস। দলগুলোর পক্ষ থেকে তীব্র বিরোধিতা না পেলে অন্যান্য ইস্যুর ক্ষেত্রেও কমিশন তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে। তখন দলগুলো চাইলে নোট অব ডিসেন্ট দিতে পারে। রাজনীতিবিদরা বলছেন, কমিশন যদি মৌলিক ইস্যুগুলোর ক্ষেত্রেও একই পলিসি গ্রহণ করে তবে সেটা ভুল হবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করা থেকে হয়তো বিরত থাকতে পারি।
আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা জানিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে জাতীয় সনদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন নিয়েও সিদ্ধান্ত জানানোর ঘোষণা দিয়েছে কমিশন। এদিকে সময়ের দোহাই দিয়ে ও আলোচনা হয়েছে এমন অজুহাত সামনে নিয়ে মৌলিক ইস্যুসহ অন্যান্য ইস্যুতে নিজেদের সিদ্ধান্ত দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চায় কমিশন- এমনটি মনে করছেন সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় না। কয়েক দিনের মধ্যে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোনো বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকলে সনদে সেটিও উল্লেখ করা হবে। অধিকাংশ বিষয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে চলে এসেছে কমিশন। সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে চলতি মাসের মধ্যেই হবে জাতীয় সনদ। অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে মীমাংসায় আসতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘ছাড় দেওয়ার’ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, আপনাদের খানিকটা ছাড় দিতে হবে, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকেও আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি যে, কোনো কোনো জায়গায় পরিবর্তন সংশোধনের মধ্য দিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ লক্ষ্য বা জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছতে পারব।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রের মূলনীতি, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (উচ্চ কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি), তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রক্রিয়া, প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া, নারী প্রতিনিধিত্ব, একজন সংসদ সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন, সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া, এ ধরনের মৌলিক কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গেছে। এ ছাড়া দেশের পুরোনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করা, বিদ্যমান জেলা পরিষদ ব্যবস্থা বাতিল করা, ওয়ার্ড মেম্বারদের ভোটে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদটি বিলুপ্ত করার প্রস্তাবে বেশির ভাগ দল একমত হয়নি। এসব বিষয়ে কয়েক দিনের মধ্যে কমিশন তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত জানাবে।
এ ক্ষেত্রে কমিশনের বক্তব্য, আমরা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করে সফল হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে কমিশন এ ভূমিকায় নেমেছে। মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা হতে পারবেন না এমন সিদ্ধান্তের বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোকে জানায় ঐকমত্য কমিশন। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, আমরা আগেই বলেছি ৭০ অনুচ্ছেদে যেমন ভিন্নমত (ডিসেন্টিং ভয়েস) রাখার সুযোগ রেখেছি, এটিও সেভাবে রাখা যেতে পারে। আমাদের অবস্থান হলো, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এমন বিধান যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কোথাও নেই। এটা তার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার।