
উত্তরা দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় এক ধরনের ট্রমার মধ্যে আছে শিশুরা। স্বাভাবিক হতে পারছে না অনেকেই। তাদের কষ্ট অবর্ণনীয়। শুক্রবার অষ্টম শ্রেণির মোহাম্মদ শাফিন নামে এক শিক্ষার্থী তার বাবার সঙ্গে স্কুলে আসে। সে (শাফিন) যুগান্তরকে বলে, আমি নিজের চোখের সামনে হতাহতের ঘটনা দেখেছি। যাদের সঙ্গে অনেক মজা করতাম। আড্ডা দিতাম। হুট করে সেই চোখের সামনে তারা মারা গেল। বলার ভাষা নেই। এটা সিমেনার দৃশ্যকে হার মানায়। এখন বিমান দেখলে ভয় কাজ করে। এই বুঝি পড়ে গেল। এছাড়া মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ যুগান্তরকে জানান, মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে শাহজাতী রিচি নামের এইচএসসি (চলমান) পরীক্ষার্থী এখনো ঘুমের মধ্যে আঁতকে ওঠে। সে কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর শুক্রবার বাসায় ফেরে। সামনে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে একরকম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। শুধু শাফিন ও রিচি নয়, তাদের মতো অনেক শিক্ষার্থী এই মুহূর্তে অনেকটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎসুক জনতা স্কুল প্রাঙ্গণে ভিড় করেছেন। এদিন সকালে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় দেখা গেলেও জুমার নামাজের পর উৎসুক হাজার হাজার লোকের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সকাল থেকে স্কুলের গেট বন্ধ রাখা হয়। এ সময় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টিম স্কুলে ঢুকতে দেখা গেছে। তারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সিলিং করেন। দুপুর আড়াইটার দিকে স্কুলে গেট সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয় কর্তৃপক্ষ। দূরদূরান্ত থেকে আসা হাজার হাজার মানুষ ভয়াবহ ঘটনা দেখতে স্কুলে ভিড় জমান। কেউ ছবি তুলছেন আবার কেউ ভিডিও করছেন। আবার কেউ হতাহতের জন্য দোয়া ও মোনাজাত করছেন। অনেকেই ঘটনাস্থলের দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বৃহস্পতিবার বিমান দুর্ঘটনার স্থানটি টিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ঘটনাস্থলে আসা রহিম নামে এক দর্শনার্থী বলেন, এই ধরনের ঘটনা ঘটবে, সেটি চিন্তার বাইরে ছিল।
এদিকে শুক্রবার সকালে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাসমিন আফরোজ আয়মান (১০) নামে এক শিক্ষার্থী মারা গেছে। এদিন দুপুরে আব্দুল মুসাব্বির মাকিন (১৩) নামে আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। সে স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মাকিনের শ্বাসনালিসহ শরীরের ৭০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। সংকটজনক অবস্থায় ছিল সে। এছাড়া আরও ৫ জন আইসিইউতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে বাংলা মাধ্যমের মাহফুজা খাতুন নামে এক শিক্ষিকাও রয়েছেন।
এই বিষয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম বলেন, আমরা হতাহতদের ঘটনা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি। যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের কাছে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যারা আহত চিকিৎসাধীন তাদের ব্যাপারে আমাদের টিম কাজ করছে। সোমবার পর্যন্ত সব ধরনের ক্লাস বন্ধ থাকবে। এরপর পর্যায়ক্রমে ক্লাস শুরু করার চিন্তাভাবনা করা হবে। তবে যেসব ক্লাসের বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ক্লাস শুরু করার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যে ভবনে ঘটনা ঘটেছে সেটি আপাতত পরিত্যক্ত থাকবে। সেখানে কোনো ক্লাস বা পরীক্ষা হবে না। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে প্রতিদিন কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিশেষ করে মেয়েরা বেশি ভেঙে পড়েছে, তাদের বিষয়ও গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। শুক্রবার মাইলস্টোন কলেজের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় আমাদের স্কুল শাখার ২৫ জন শিক্ষার্থী, ২ জন শিক্ষক, ৪ জন অভিভাবক মৃত্যুবরণ করেন। এ দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আছেন ৫০ জন। এদের মধ্যে ৩৯ শিক্ষার্থী, ৭ জন শিক্ষক, ১ জন অভিভাবক, ২ জন আয়া ও ১ জন পিয়ন রয়েছেন। এ ঘটনায় ২২ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ শুধু এ প্রতিষ্ঠানে নিহত, আহত ও নিখোঁজের তথ্য তুলে ধরছে। কর্তৃপক্ষের তথ্য হালনাগাদের কাজ চলমান। এ ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা তুলে ধরছে আইএসপিআর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। হৃদয়বিদারক এ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের শোকাহত সদস্যদের প্রতি আমরা গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আহতদের চিকিৎসাসহ সব প্রয়োজনে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ সর্বদা পাশে রয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমাদের শিক্ষার্থী ও সন্তান হারানোর এই চরম শোকসন্তপ্ত অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, অভিভাবক ও এলাকাবাসীসহ পুরো জাতি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রত্যেকেই তাদের অবস্থান থেকে সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গুরুতর আহতদের উন্নত ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এ ব্যাপারে চিকিৎসা ও সেবা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি জরুরি সেল গঠন করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী।