Image description
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ

আড়াই বছরের শিশুকন্যা সোহা আখঞ্জী সারাক্ষণ বাবা বাবা বলে ডাকে আর কাঁদে। চারপাশে বাবাকে খোঁজে। অবুঝ শিশুটি জানে না, তার বাবা সাংবাদিক সোহেল আখঞ্জী ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন। পাড়ি জমিয়েছেন অন্য ভুবনে।
কোনো দিন আর ফিরে আসবেন না।

কিন্তু এ কথা বিশ্বাস করতে চায় না সোহেল আখঞ্জীর ১০ বছরের আরেক কন্যা শিমু আখঞ্জী ও পাঁচ বছরের ছেলে সামী আখঞ্জী। তারা তাদের মাকে অনবরত বলতে থাকে, ‘মা, আব্বারে মোবাইল করে কও জলদি বাড়িত আইতে। আব্বারে কত দিন ধইরা দেখি না, একসাথে ভাত খাই না।
আব্বাও আয় না, কেউ বাজার থাইক্যা আমরার লাগি মিঠাইও আনে না। মা, বাবাকে কল দেও।’

সন্তানদের এসব কথায় নীরবে অশ্রু ফেলেন সাংবাদিক সোহেল আখঞ্জীর স্ত্রী মৌসুমী আক্তার। তিন সন্তানকে নিয়ে শঙ্কা, ভয় ও অনিশ্চয়তায় কাটছে তাঁর দিন।

গত বছর ৫ আগস্ট। হবিগঞ্জের বানিয়াচং। সকাল ১০টা থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মিছিল বের করে। মিছিলকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে আন্দোলনকারীদের। এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলার ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে বানিয়াচং থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সাংবাদিক সোহেল আখঞ্জী।
হবিগঞ্জের স্থানীয় দৈনিক ‘লোকালয় বার্তা’র স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৩ বছর। তিনি বানিয়াচংয়ের সাগর দিঘির পূর্বপারের মোশাহিদ আখঞ্জীর ছেলে।  

শহীদ সোহেল আখঞ্জীর স্ত্রী মৌসুমী আক্তার জানান, মানসিক সমস্যার কারণে সোহেল আখঞ্জীর ছোটবেলায় তাঁর মা অন্যত্র চলে যান। বাবাও বেঁচে নেই। এ জন্য তাঁদের পাশে দাঁড়ানোরও কেউ নেই। তিন সন্তান নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন পার করছেন তিনি। সরকার ও জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে নগদ পাঁচ লাখ ও ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেছেন আর মাথা গোঁজার ঠাঁই একটি ঘর নির্মাণ করেছেন। ফলে বর্তমানে তিন সন্তান নিয়ে অনেকটা কষ্টের মধ্যে আছেন। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে পঞ্চম শ্রেণি, ছেলে প্লে-গ্রুপে পড়ে। আর ছোট মেয়ের বয়স মাত্র আড়াই বছর। সোহেল আখঞ্জী মারা যাওয়ার সময় ছোট মেয়ে সোহার বয়স ছিল দেড় বছর।

মৌসুমী আক্তার বলেন, ‘এক বছর হয়ে গেল, এখনো আমার স্বামী হত্যার বিচার পাইনি। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমার বাচ্চারা ‘বাবা’ বলে ডাকে আর কাঁদে। তাদের বোঝাতে পারি না। চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। যারা আমাকে বিধবা করেছে, আমার সন্তানদের বাবা ডাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তাদের ফাঁসি চাই।’

সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে মৌসুমী আক্তার বলেন, ‘আমার সন্তানদের পড়ালেখার দায়িত্ব যদি সরকার নিত, তাহলে অনেক উপকার হতো। আমি লাখাই মুক্তিযোদ্ধা জিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেছি। যোগ্যতা অনুযায়ী সরকার যদি আমাকে একটা চাকরি দিত, তবে সন্তানদের নিয়ে দুইবেলা খেয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম।’

বানিয়াচং থানার ওসি গোলাম মোস্তফা জানান, এ মামলার অনেক আসামিকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

শহীদ সাংবাদিক সোহেল আখঞ্জী একসময় সৌদিআরব ও কাতার প্রবাসী ছিলেন। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে শুরু করেন সাংবাদিকতা। গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের পুরোটা সময় আন্দোলনকারীদের পাশে ছিলেন তিনি। আন্দোলনের ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত শেয়ার করেছেন। পত্রিকায় রিপোর্ট লিখেছেন। শহীদ হওয়ার দিন সংবাদ সংগ্রহের জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে আন্দোলনকারীদের সামনের কাতারে ছিলেন।