Image description

প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে দেশকে ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল ক্ষতি থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের বেশ উন্নতি হয়েছে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে গাছের ঘনত্ব, কাঠের পরিমাণ ও গ্রোয়িং স্টক বেড়েছে। সুন্দরবনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কার্বণ বাণিজ্যের সম্ভাবনা।

সুন্দরবন ছাড়াও উপকূলের বিভিন্ন জেলায় ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ সৃজন করা হয়েছে।

ম্যানগ্রোভ এক বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ, যা সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের নোনা পানিতে জন্মায়। এগুলো শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদ। ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং এর প্রতিবেশ সুরক্ষায় প্রতিবছর ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস পালিত হয়।

২০১৫ সালের সাধারণ অধিবেশনে ইউনেসকো দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর আগে ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবনকে রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে একমাত্র সক্রিয় বদ্বীপ সুন্দরবনে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ঘন ঘন আগুন, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট নানা কর্মকাণ্ড।

বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে হেক্টরপ্রতি গাছের ঘনত্ব, কার্বণ শোষণের পরিমাণ, বায়োমাস বা কাঠের পরিমাণসহ নানা বিষয়ের তথ্য জানতে জরিপ করা হয়। ২০১৯ সালে প্রথম জরিপ এবং পাঁচ বছর পর দ্বিতীয় বন জরিপ পরিচালিত হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে সুন্দরবনে মোট কার্বন শোষণ ছিল ছয় কোটি ৬০ লাখ ৪০ হাজার টন। ২০২৫ সালে তা উন্নীত হয়েছে সাত কোটি পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টনে। ফলে পাঁচ বছরের ব্যবধানে কার্বন শোষণ বেড়েছে ৪৫ লাখ ১০ হাজার টন।

প্রতি টন কার্বনের বাজারমূল্য ৪০ মার্কিন ডলার হিসেবে ধরলেও বর্ধিত কার্বনের মূল্য দাঁড়ায় ছয় কোটি ৬২ লাখ ডলার। এক ডলার সমান ১২৫ টাকা হিসেবে, যা টাকায় দাঁড়ায় আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ফলে জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কার্বন বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হবে। ২০১৯ সালে প্রতি হেক্টরে বায়োমাস বা কাঠের পরিমাণ ছিল ৯৮.৩৮ টন। ২০২৫ সালে তা উন্নীত হয়েছে প্রতি হেক্টরে ১১১.২০ টনে। ২০১৯ সালে সুন্দরবনে গ্রোয়িং স্টক ছিল ৯৭.৭৫ ঘন মিটার। ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৪.৭০ ঘন মিটারে।

বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের মধ্যে অবস্থানরত উদ্ভিদ ও প্রাণীর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে সুন্দরবনে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব ছিল সাত হাজার ৩৪৫টি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৫৫৩টিতে। ফলে পাঁচ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে গাছের ঘনত্ব বেড়েছে ২০৮টি। বাঘের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার বাঘ যেসব প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে সেগুলোর পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে।’

ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুরক্ষায় কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কমিউনিটিভিত্তিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করা হচ্ছে। বন তদারকিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। আবার উপকূলীয় অঞ্চলে কৃত্রিমভাবে ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করা হয়েছে। প্রকৃতি সৃষ্ট এসব চরাঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনায়নের মাধ্যমে দেশে নতুন ভূমি যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধ করে মানুষের বসবাসের উপেযাগী করে তোলা সম্ভব হয়েছে।’

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন প্রধান। সুন্দরবনে ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বিশ্বে প্রায় ৪৮ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বা শ্বাসমূলীয় বৃক্ষ রয়েছে। যার ৩৫ প্রজাতি রয়েছে সুন্দরবনে। এ ছাড়া কক্সবাজারে মাতামুহুরী নদীর মোহনায় ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে, যা ‘চকোরিয়া সুন্দরবন’ নামে পরিচিত। টেকনাফের কাছাকাছি নাফ নদের তীরেও একটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। টেকনাফ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণাংশে একটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। উপকূলের প্রতিকূল ও লবণাক্ত মাটিতে গরান, বাইন ও কেওড়াগাছ ভালো জন্মায়। এ অঞ্চলে এসব গাছের চারা রোপণ করে কৃত্রিমভাবে ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৯টি উপকূলীয় জেলায় প্রায় ৬২ হাজার ২৫৫ হেক্টর চরে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের ম্যানগ্রোভ বনের মোট আয়তন ১০ হাজার ২৮০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ ভারতের পশ্চিবঙ্গে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ কমিয়ে ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা কমিয়ে আনছে সুন্দরবন। ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ৪৮ বার তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং ৪৯ বার ঘূর্ণিঝড় এবং ২০ বার হারিকেন হয়েছে। এ ছাড়া ছোট-বড় নানা ধরনের জলোচ্ছ্বাস তো আছেই। সবমিলিয়ে প্রতি তিন বছর পর পর দেশে বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। সুন্দরবনের কারণে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা চার থেকে ১৬.৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কমিয়ে আনছে। আবার পানিপ্রবাহের ভেলোসিটি কমিয়ে আনছে ২৯ থেকে ৯২ শতাংশ। ফলে ঢেউয়ের গতিবেগকে কমিয়ে দিয়ে জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করছে উপকূলের মানুষ ও পরিবেশকে। কমিয়ে আনছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি।

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আগুন, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড

সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডে ওই এলাকার যৌগিক বাস্তুতন্ত্র, বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করছে। গত ২৪ বছরে সুন্দরবনে ২৬ বার আগুন লেগে সরকারি হিসাবে প্রায় ৭৫ একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। ২৪টি তদন্ত প্রতিবেদনে ১৫ বার বনজীবীদের ফেলে আসা আগুন থেকে এসব আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের জমি দখল ও প্রাণবিনাশী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই অগ্নিকাণ্ডের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার। এ ছাড়া পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে সুন্দরবনের মতো মহামূল্যবান এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মাঝখান দিয়ে নৌ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ঝুঁকি ও ক্ষতি মোকাবেলায় উদ্যোগ না নিলে সুন্দরবন পুরোপুরি সুন্দরী গাছহীন হয়ে পড়তে পারে।