Image description
সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় দক্ষ জনবল সংকট আইনি কাঠামো সম্পর্কে অজ্ঞতা * যুক্তরাষ্ট্রে বাংলায় আইনের কপি পাঠানো হয়েছে

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে পাচার করা সম্পদ ফেরানোর কাজে পাহাড়সম সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিদেশে প্রয়োজনীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার সংকট কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ওইসব দেশের ভাষায় দক্ষ জনবলের অভাব, আইনি কাঠামো সম্পর্কে না জানার কারণে কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পাচার করা বেশকিছু সম্পদ বিদেশে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২২টি দেশে বড় শিল্প গ্রুপগুলোর পাচার করা সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। ৯টি দেশে সম্পদের তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো জব্দ করতে ৯টি দেশে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়েছে। যুক্তরাজ্যে তিনজনের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এখন এগুলো দেশের নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে দ্রুত আইনসম্মত যোগাযোগ, পাশাপাশি বিদেশে আইনি লড়াই চালানোর মতো কৌশল ও সে দেশের আইনি কাঠামো সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের অভাব। এসব সমস্যায় পাচার করা টাকা ফেরানোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

২২টি দেশে পাচারের সম্পদ চিহ্নিত হলেও এসব দেশের ভাষা এক নয়। ফলে অনেক দেশের ভাষা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানেন না। যে কারণে ওইসব দেশের নিজস্ব ভাষায় এমএলএআর পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি অন্যান্য যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না। আবার কিছু ক্ষেত্রে গাফিলতিও আছে। যেমন ভূমিমন্ত্রীর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংশ্লিষ্ট আইনের কপি চেয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ থেকে বাংলায় আইনের কপি পাঠানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরে এর ইংরেজি ভার্সন পাঠাতে বলা হয়েছে। অবশ্য পরে আইনটির ইংরেজি ভার্সন পাঠানো হয়েছে।

এখন আবার সব দেশের সঙ্গেই ইংরেজিতে চিঠি আদান-প্রদান করা হচ্ছে। ইংরেজি ভাষায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে যোগাযোগে সুবিধা হচ্ছে। কিন্তু বাকি দেশগুলোতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কয়েকটি দেশ ছাড়া বাকি সব দেশের আইনই নিজস্ব ভাষায় তৈরি। সেগুলো অনলাইন থেকে সংগ্রহ করে ইংরেজিতে রূপান্তর করা চ্যালেঞ্জিং। এছাড়া সব দেশের আইনকানুন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কাজে দক্ষ জনবলও নেই। যে কারণে এমএলএআর পাঠানোসহ অন্যান্য যোগাযোগ করার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এ ধরনের সমস্যাগুলো সমাধানে প্রথমে একটি নতুন অধ্যাদেশ প্রণয়নের চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্ত এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয় বলে অধ্যাদেশের পরিবর্তে প্রচলিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে কাজ করছে। বর্তমানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপের টাকা পাচারের ঘটনা তদন্তে ১১টি টিম গঠন করা হয়েছে। এতে সরকারি ৫টি তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা সমন্বিতভাবে কাজ করছেন।

সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপ সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকদের পক্ষে দেশ থেকে টাকা পাচার করেছে। ওইসব টাকা নানাভাবে তাদের দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পাচার করা টাকার বিপরীতে ব্যবসায়িক অংশীদার করা হয়েছে সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকদের। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে এমন কয়েকটি গ্রুপ চিহ্নিত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ টিমের মাধ্যমে অনুসন্ধান শুরু করে। প্রায় এক বছর হতে চলেছে ওইসব অনুসন্ধানে ২২টিরও বেশি দেশে পাচার করা সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশগুলো হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সেন্ট কিডস অ্যান্ড নেভিস, সুইজারল্যান্ড, সাইপ্রাস, স্লোভাকিয়া, জার্সি, আইল অব ম্যান, আলবেনিয়া, কানাডা, ডমিনিকা, লুক্সেমবার্গ, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, হংকং, ক্যামন দ্বীপুঞ্জ ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড। এসব দেশে পাওয়া সম্পদের মধ্যে ৯টি দেশের সম্পদ সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের সম্পদ জব্দ করতে তিনটি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে। যুক্তরাজ্য কিছু সম্পদ জব্দ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র জব্দ করতে আরও নথিপত্র চেয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া দেয়নি। বেক্সিমকো গ্রুপের সম্পদ উদ্ধারে দুটি এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে কিছু সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। অন্য একটি দেশে আলোচনা চলছে। একটি গ্রুপের বিষয়ে ৯টি দেশে সম্প্রতি এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। নাসা গ্রুপের বিষয়ে তিনটি দেশে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। জেমকম গ্রুপের এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। সামিট গ্রুপের এমএলএআর তৈরির পর সেগুলো ভেটিং হচ্ছে। অন্য গ্রুপগুলোর পাচার করা সম্পদের তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার করা সম্পদের তথ্য প্রথমে সংগ্রহ করতে হয় ওপেনার্স সোর্সের (উন্মুক্ত বা অনানুষ্ঠানিক সোর্সের) মাধ্যমে। পরে ওইসব তথ্য বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সোর্সের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হয়। পাচার করা সম্পদের বিষয়ে ওপেন সোর্সে প্রাপ্ত তথ্য নিশ্চিত করতে সম্প্রতি সরকারি একটি দল কয়েকটি দেশে তদন্ত করে এসেছে। তারা পাচারকারীদের গড়া সম্পদের ঠিকানা ও ছবিও তুলে এনেছে। এখন ওই দেশের সরকারি দপ্তর থেকে এসব সম্পদের মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রথমে দরকার মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট পাঠানো। এটি পাঠাতে একেক দেশের একেক নিয়ম। এটি লিখতেও হয় একেক দেশের একেক নিয়মে। একেক সংস্থার কাছে এগুলো পাঠাতে হয়। এজন্য যে দেশে এমএলএআর পাঠানো হবে ওই দেশের আইনকানুন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হয়। কোন সংস্থা এ বিষয়গুলো দেখাশোনা করে সেটিও জানতে হবে।

একই সঙ্গে সব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইংরেজিতে দক্ষ নন। তাদের নিজস্ব ভাষায় তারা দক্ষ। এ কারণে ওইসব দেশের নিজস্ব ভাষায় এমএলএআর পাঠানো হলে বেশি কার্যকর এবং দ্রুত সাড়া মেলে। এছাড়া পাচারকারীরা সব দেশেই বিনিয়োগকারী বা আমানতকারী হিসাবে সে দেশের আইনে সুরক্ষা পাচ্ছেন। পাচারের সম্পদ দাবি করতে হলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে তিনি (পাচারকারী) বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কর ফাঁকি দিয়ে বেআইনিভাবে নেওয়া হয়েছে। এটি প্রমাণ করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদন্ত প্রতিবেদন, এর আলোকে মামলায় আদালতের রায় লাগবে। এসব তদন্ত প্রতিবেদন ও রায় ইংরেজিতে বা সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় পাঠাতে হবে। যেটি সম্ভব হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত আলোচিত সব গ্রুপের তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি। কয়েকটি গ্রুপের মামলায় আদালত শুধু সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু মামলার রায় এখনো হয়নি। এসব আদেশের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও বেক্সিমকোর কিছু সম্পদ জব্দ করেছে ব্রিটেন সরকার।

এছাড়া বাংলাদেশের ইমেজ সংকট একটি বড় বিষয়। পাচারকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করছে তাকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য বাংলাদেশ সরকার এসব করছে। সেটিকে তারা আমলে নিচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক হয়রানির অনেক উদাহরণ রয়েছে। ফলে পাচারের বিষয়ে নিখুঁত ও অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হচ্ছে। যা সংগ্রহ করা ও উপস্থান করা সময়সাপেক্ষ।

এছাড়া পাচার করা সম্পদের বিষয়ে অনেক দেশই তথ্য দিচ্ছে না। কারণ তাদের দেশে পাচারকারী আইনি সুরক্ষা পাচ্ছেন। যেসব দেশে সম্পদ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো এখন জব্দ করার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। এটিও দেরি হচ্ছে দক্ষ জনবলের অভাবে। কারণ বাংলাদেশে এ ধরনের কাজের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে কোনো কাজই এক জায়গা থেকে করা সম্ভব হচ্ছে না। যেজন্য কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।