
‘চোখের সামনে অনেক ছোট ভাই-বোনকে পুড়তে দেখেছি। কারও শরীর ছিন্নভিন্ন। বুঝতেই পারছিলাম না—আমি স্বপ্ন দেখছি, নাকি সত্যি!’ উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরাজ দিচ্ছিলেন এমনই এক বিভীষিকার বর্ণনা। নিজ চোখে দেখা এমন দৃশ্য কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি। মনের মধ্যে গেঁথে গেছে সেই দুঃসহ স্মৃতি। এ থেকে কীভাবে কাটিয়ে উঠবে তারা, সেই প্রশ্ন সবার মনে।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণরত একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে আহত হন শতাধিক, নিহত হয়েছেন ২৯ জন। আহত এবং নিহতদের বেশিরভাগই শিশু। সহপাঠীর এমন করুণ পরিণতিতে স্তব্ধ শিক্ষার্থীরা। এই ঘটনার পর অনেকেই স্বচক্ষে দেখেছেন শিশুদের পোড়া দেহ, বিচ্ছিন্ন অঙ্গ, রক্তাক্ত এক পরিবেশ। অনেকেই উদ্ধার করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। সবার মনেই আঘাত করেছে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যে শিশুটি সেদিন স্কুলে যায়নি তার মনেও তৈরি হয়েছে ক্ষত।
একই প্রতিষ্ঠানের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী অনিক শেখ বলেন, ‘জীবনে প্রথম মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখলাম। আগুন, ধোঁয়া আর ছুটোছুটি—এই শব্দগুলো মাথায় গেঁথে গেলো। আমাদের স্কুলটা যেন এক নিমিষেই মৃত্যুপুরী হয়ে উঠলো।’
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিনহাজ জানায়, ‘আমি তখন স্কুল ক্যান্টিনে খাবার খাচ্ছিলাম, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনি। দেখলাম, বিমানটি দোতলা ভবনে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। সবাই চিৎকার করছে, দৌড়াচ্ছে। অনেক ছোট ভাই-বোনের শরীরে আগুন ধরে যায়।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বড় ধরনের দুর্ঘটনা স্বচক্ষে দেখলে সবার মনেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত ট্রমায় শিশুদের মধ্যে দেখা দিতে পারে তীব্র মানসিক চাপ, কনভার্সন ডিজঅর্ডার, সাময়িক উন্মাদনা, প্যানিক অ্যাটাক, দুশ্চিন্তা, অস্বাভাবিক শোকার্ত ভাব। দুই সপ্তাহ পর থেকে কয়েক মাসের মধ্যে দেখা দিতে পারে আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপ, যাকে বলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা পিটিএসডি।’
বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহ উদ্ধর করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরীর মতে, ‘তীব্র শোক বা মানসিক আঘাত পেলে যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পিটিএসডি। এই রোগের প্রধান কিছু লক্ষণ হচ্ছে- যে ঘটনা বা অভিজ্ঞতা ব্যক্তির মনে আঘাত সৃষ্টি করেছে, তা বারবার ফিরে আসে। ঘটে যাওয়া ট্রমাটিক ঘটনা কখনও বাস্তব স্মৃতি হয়ে, কখনও কল্পনা বা দুঃস্বপ্নের মধ্যে চলে আসে। ব্যক্তি বারবার সেই স্মৃতিতে আতঙ্কিত বোধ করে, মনে করে তার জীবনে আবারও সেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এ ছাড়া আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে—ব্যক্তির স্বাভাবিক আবেগের বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক, রাগ বা অস্থিরতা প্রকাশ করা।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের স্মৃতিতে এই ধরনের ট্রমার অভিজ্ঞতা একটি অস্বাভাবিক গড়ন ও মাত্রা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে যেতে পারে। পরে তাদের মধ্যে দেখা দিতে পারে ব্যক্তিত্বের সমস্যা। যে শিশু বা কিশোর নিজে সরাসরি এ ধরনের দুর্ঘটনা বা ট্রমার মুখোমুখি হয়েছে, কেবল সে নয়, বরং যে শিশু সেটি দেখেছে বা শুনেছে, তারও সমস্যা হতে পারে। মানসিক আঘাত পেতে পারে এমন ঘটনা বা ট্রমার মুখোমুখি হয়েছে এমন শিশুর প্রতি শুরু থেকেই বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত, যাতে এই আঘাত সে কাটিয়ে উঠতে পারে। এ জন্য তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।’
বড় ধরনের ট্রমা প্রত্যক্ষ করার পর শিশুদের প্রতি দায়িত্বশীল করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার ভয়াবহ দৃশ্য আর ঘটনা সরাসরি বা প্রচারমাধ্যমে শিশু-কিশোরদের দেখতে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বীভৎস কোনও কিছু প্রত্যক্ষ করা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যমগুলোকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। মৃতদেহের ছবি, আহত মানুষের কাতরানোর দৃশ্য দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া শিশুদের রাতের ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। তবে জোর করে তাদের কোনও কিছু করতে বাধ্য করা যাবে না। ট্রমার মুখোমুখি হওয়া শিশুর রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে, দুঃস্বপ্ন দেখতে পারে, বিছানায় প্রস্রাব করতে পারে, অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে (বিনা কারণে হাসা, কাঁদা, আপনজনকে চিনতে না পারা, কথা বলতে না পারা, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি)। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।’
ডা. হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের সংবেদনশীল মনকে সুরক্ষা দিতে হবে, তাদের আবেগ, শোক প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। ট্রমার মুখোমুখি হওয়া শিশুদের কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। শিশুকে অহেতুক ভয় দেখানো যাবে না। যদি মনে হয় শিশু স্বাভাবিক কাজ করার মতো বা আবার স্কুলে যাওয়ার মতো নিজের মনকে তৈরি করতে পারেনি, শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তবে সময় নিতে হবে, জোর করা যাবে না। তাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে উৎসাহিত করতে হবে।’