
জাতীয় শোক আর উদ্বেগের এই মুহূর্তেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের উগ্রবাদী সমর্থকদের উল্লাস, কটাক্ষ ও গুজব ছড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের এই আচরণ জনসাধারণকে হতবাক ও বিস্মিত করছে।
ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই ফেসবুকে পতিত ফ্যাসিবাদী দলটির নেতাকর্মীরা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় তৈরি করতে থাকেন। একই সঙ্গে তাদের সমালোচকদের উদ্দেশে সংঘবদ্ধ হয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করতে থাকেন।
এমন স্পর্শকাতর দুর্ঘটনার বিষয়েও জুলাই গণহত্যায় অভিযুক্ত একটি দলের নেতা-কর্মীদের এই ধরনের আচরণ জনমনে প্রশ্ন তোলে যে, এই ট্র্যাজেডিও কি রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ থেকে মুক্ত থাকতে পারল না?
কার্যক্রম নিষিদ্ধ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে লিখেছে, ‘দেশটা এখন মৃত্যুপুরী, তার ওপরে লাশ চুরি!’ অন্য একটি পোস্টে বলা হয়েছে, ‘লাশের সংখ্যা নিয়ে নয়-ছয়, ...লাশের হিসাব চাই। ’ আরও এক পোস্টে তারা লিখেছে, ‘...প্রতিবাদ করলেই চলছে আক্রমণ। এটি কোনো রাজনীতি নয়, অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হও। ’
দুর্ঘটনায় মুষড়ে পড়া লোকজনকে উসকে দিতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটি আরেক পোস্টে দাবি করেছে, ‘মাইলস্টোনের বাচ্চাগুলোরে বাঁচান, যারা শত শত লাশের প্রত্যক্ষদর্শী, তাদের ওপর হামলা হতে যাচ্ছে। হোস্টেলে আটকে রাখা হয়েছে বাচ্চাগুলোকে, পুড়িয়ে অন্য লাশের সাথে মিশিয়ে ফেললে টের পাওয়া যাবে না। প্লিজ, কেউ কিছু করেন। ’
অন্যদিকে, এই ট্র্যাজেডিতে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে প্রাসঙ্গিক করতে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ তাদের ফেসবুক পেজে তার ছবি পোস্ট করে লিখেছে, ‘দ্য আলটিমেট ক্রাইসিস ম্যানেজার’।
পতিত স্বৈরাচার হাসিনার অনুসারীরা তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনকে নিয়েও অপপ্রচার চালাচ্ছে। আগে থেকেই এটি জানা যে, অভ্যুত্থানের সময় সামন্ত লাল আত্মগোপনে চলে যান এবং এরপর থেকে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
অথচ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের দাবি, ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার ক্রান্তি লগ্নে দেশের অন্যতম এই বার্ন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বর্তমান সরকার তাকে জেলে ভরে রেখেছে।
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ডা. সামন্ত লাল সেনকে ঘিরে ছড়ানো এই প্রোপাগান্ডার বিষয়টি যাচাই করতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে ফোন রিসিভ করে অসুস্থতার কথা জানিয়ে কল রেখে দেন। সংবাদমাধ্যমের খবর, তিনি দেশেই অবস্থান করছেন এবং আত্মগোপনে রয়েছেন।
সামন্ত লাল সেনকে নিয়ে ছড়ানো ভুয়া তথ্য দেখে সাধারণ নেটিজেনরাও ক্ষিপ্ত। ইকরামুল কবির নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দেশের ইতিহাসের ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনার সময় তিনি প্রকাশ্যে আসেননি, কোমলমতি দগ্ধ শিশুদের দেখতে যাননি। আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা তার গ্রেপ্তারের ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে, যা লজ্জাজনক। ’
অভ্যুত্থানের পর কিছুদিন দেশে আত্মগোপনে থেকে পরে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রব্বানী ফেসবুকে লাশ গোপনের অভিযোগ তুলে লিখেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের বসানো সরকার এখন শিক্ষার্থীদের লাশের সংখ্যা গোপন করছে। সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করতে গেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মারধর করছে, শোকাহত বাচ্চাদের ওপর আঘাত করছে, গ্রেনেড ও গ্যাস মেরে বেধড়ক পেটাচ্ছে, মাথা ফাটাচ্ছে, গুলি করছে। হায় সেলুকাস!’
তবে সাধারণ নেটিজেনদের সবচেয়ে বেশি অবাক করে এই ট্র্যাজেডিতে আওয়ামী লীগের চরমপন্থি একটি অংশের ন্যক্কারজনক উল্লাস। দুর্ঘটনায় দ্বিতীয়, তৃতীয় থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া শিশুরা মারা গেলেও আওয়ামী লীগের ওই কট্টরপন্থিরা তাদের জুলাই অভ্যুত্থানের সৈনিক হিসেবে চিহ্নিত করে ‘লাল বিপ্লবী’ বলে উপহাস করতে থাকে।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগের অ্যাক্টিভিস্ট রাসেল রহমানের একটি পোস্ট ওই দলের সমর্থকরা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন। ওই পোস্টে লেখা হয়, ‘এই মাইলস্টোনের .... জুলাইয়ে উত্তরায় সবার আগে রাস্তা আটকিয়েছিল। তারা দেয়ালে দেয়ালে লিখেছিল, তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার। ’ ওই পোস্টে আরও আপত্তিকর কিছু শব্দও ব্যবহার করেন তিনি। পোস্টটি ভাইরাল হওয়ার পর তিনি তা সরিয়ে ফেলেন।
বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ৩১, আহত ১৬৫
আজ দুপুর সোয়া ২টায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত ও অন্তত ১৬৫ জন আহত হয়েছেন। আহতদের বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ও অ্যাম্বুলেন্সের সহায়তায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)সহ নিকটস্থ বিভিন্ন হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে।
আইএসপিআর জানায়, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে বিমান বাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হচ্ছে। এছাড়াও আহত ও নিহতদের জন্য দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।