Image description
 

সকাল ৬টা ৫২ মিনিট। দিনাজপুর সরকারি কলেজ মোড়। এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে বাস কাউন্টারে বসে আছেন মা। যাবেন রংপুর। পরীক্ষার্থী বাসে উঠে পড়েন।

বাসে তখন বসে ছিলেন ওই শিক্ষার্থীর এক শিক্ষক। তাঁর কাছ থেকে আজ মঙ্গলবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিতের কথা শুনে বাস থেকে নেমে আসেন পরীক্ষার্থী।

এবার শিক্ষকও বাস থেকে নামেন। তিনি অভিভাবকের কাছে গিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত ও নিশ্চিত করে বলেন, আজকের পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা এসেছে।

মিনিট দুয়েকের মধ্যে বাসটি ছেড়ে যায়। কিন্তু পরীক্ষার্থী মেয়েকে নিয়ে অভিভাবক মা কাউন্টারে দাঁড়িয়েই রইলেন। পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি আরও ভালো করে নিশ্চিত হতে তিনি একে-ওকে ফোন করেন।

প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি তখন ঘটনাস্থলেই ছিলেন। তিনি এগিয়ে যান, নিজের পরিচয় দিয়ে ওই পরীক্ষার্থী-অভিভাবককে পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন।

এবার অভিভাবক বলতে লাগলেন, ‘ফেসবুক থেকে জেনেছি। রাতে স্যারকে ফোন করেছি, কিন্তু তিনিও বলতে পারছিলেন না। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা স্থগিতের দাবি জানাচ্ছেন, সেটিও দেখছি। কিন্তু কোনো কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। সবশেষ প্রথম আলো অনলাইনে দেখলাম পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। এবার নিশ্চিত হই। কিন্তু তারপরও মেয়েকে নিয়ে বের হইছি। হঠাৎ যদি সিদ্ধান্ত বদলে যায়? যেহেতু মেয়েটার পরীক্ষার সেন্টার রংপুরে...।’

ওই পরীক্ষার্থীর মতো অনেকে আজ মঙ্গলবার সকালে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে জানলেন পরীক্ষা স্থগিত। কোনো কোনো শিক্ষক পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনের জন্য বের হবেন, তখন জানলেন আজ পরীক্ষা হবে না।

আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরীক্ষা স্থগিতের খবর পেলেও দোটানায় পড়ে কেউ কেউ পরীক্ষা দিতে রওনা দেন। অনেকে অবশ্য ভোররাতেই খবর পেয়ে যান, আজ পরীক্ষা হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বহীনতায়। সরকারের পক্ষ থেকে রাত পৌনে তিনটায় পরীক্ষা স্থগিতের কথা জানানো হয়। প্রশ্ন উঠেছে, কেন সিদ্ধান্তটি আরও আগে নেওয়া হলো না, আগে জানানো হলো না।

কেউ কেউ বলছেন, এটা শিক্ষার্থীদের সরকারের সংবেদনশীলতার অভাব এবং সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতার ফল। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গতকাল সোমবার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এত শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনার পর সরকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারত।

আজ অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়।

ফেসবুকে ঘোষণা

এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয় গত ২৬ জুন। এবার পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী। সূচি অনুযায়ী আজ (২২ জুলাই) রসায়ন (তত্ত্বীয়) দ্বিতীয় পত্র/ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি দ্বিতীয় পত্র (মানবিক শাখা) /ইতিহাস দ্বিতীয় পত্র/গৃহ ব্যবস্থাপনা ও পারিবারিক জীবন দ্বিতীয় পত্র/উত্পাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা ছিল।

পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা প্রথম আসে গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ২টা ৪১ মিনিটে। ওই সময় তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমের ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, ‘শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়ের সাথে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব মাহফুজ আলমের সাক্ষাৎ হয়েছে। আজকের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা।’

পরে এই পোস্ট মাহফুজ আলমের ভেরিফায়েড পেজে শেয়ার করা হয়।

দিবাগত রাত ২টা ৫০ মিনিটে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, ‘আজকের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।’

এরপর দিবাগত রাত তিনটার দিকে ‘জরুরি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’ হিসেবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মামুন অর রশিদ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সাংবাদিকদের বলেন, রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবারের (২২ জুলাই, ২০২৫) এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা।

যদিও তখন পর্যন্ত শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। এরপর আজ সকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি জানানো হয়।

পাশাপাশি সকালে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষা স্থগিতের কথা জানায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় গতকাল বিকেলেই আজকের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

শোকাবহ এই পরিস্থিতিতে কোনো কোনো কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্থগিতের দাবি জানানো হচ্ছিল। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে এইচএসসির মতো একটা বড় পাবলিক পরীক্ষার বিষয়ে এত বিলম্ব করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্যও করছেন।

অবশ্য আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির আজ প্রথম আলোকে বলেন, সকালেই জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় কোনো অসুবিধার কথা তাঁদের কাছে কেউ জানায়নি।

এদিকে আজ রাজধানীতে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা সচিবালয়ে ঢুকে পড়েন। এরপর সচিবালয়ের ভেতর পার্কিং অবস্থায় থাকা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সচিবালয়ের সামনে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের অনেকে আহত হয়েছেন।

মাইলস্টোন কলেজেও বিক্ষোভ হয়। সেখানে আটকা পড়েন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

শিক্ষার্থীরা যে ৯ দফা দাবি করেছেন, তার মধ্যে ৫ নম্বরটি হলো রাত তিনটায় পরীক্ষা স্থগিত আনপ্রফেশনাল (অপেশাদার) কাজ। শিক্ষা উপদেষ্টা বা মন্ত্রণালয় কোনো বিবৃতি দেয়নি। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ‘আমরা মেরুদণ্ডহীন শিক্ষাব্যবস্থা, মন্ত্রণালয় চাই না, দ্রুত উপদেষ্টার পদত্যাগ করতে হবে।’

৯ নম্বর দাবিতে বলা হয়েছে, শোক ঘোষণা করে পরীক্ষা নেওয়া প্রহসনমূলক কাজ, এর জবাবদিহি করতে হবে।

‘এর দায় কার’

পরীক্ষা আজ সকাল ১০টায় শুরু হওয়ার কথা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী অন্তত আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হয়। সে হিসেবে অনেকেই সকালের দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যান। ফলে যাঁরা নিশ্চিত হতে পারেননি, তাঁদের কেউ কেউ পরীক্ষার কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা দেন।

ফরিদপুরের একটি কলেজের একজন শিক্ষক আজ সকাল ৯টা ৫২ মিনিটে তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, ‘ভোররাত থেকে স্টুডেন্টের কল—স্যার, পরীক্ষা নাকি স্থগিত হয়েছে? বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম, এই বিষয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি নেই। বললাম না, এখন পর্যন্ত অফিশিয়ালি স্থগিত হয়নি। পরীক্ষা শুরু ১০টা থেকে। কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হয় ৯টা ৩০-এর ভেতরেই। অনেক পরীক্ষার্থী বাসা থেকে রওনা হন ৮টা ৩০-এর আগেই। অফিশিয়ালি স্থগিতের বিজ্ঞপ্তি এল ৭টা ২০-এর দিকে।

ওই শিক্ষক আরও লিখেছেন, ‘আমি বাচ্চাকে স্কুলে দিতে এসে দেখলাম যেসব শিক্ষার্থী ফেসবুক বা টিভি দেখে না, তারা কেন্দ্রে চলে আসছে। এই যে এরা ভোগান্তিতে পড়ল এর দায় কার বা কাদের?’

গভীর রাতে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্তকে অসংবেদনশীল বলে উল্লেখ করেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও দেখা গেছে, সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের সময় লাগে। আবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেটা পাল্টে যায়।

তিনি বলেন, জনগণের পরিস্থিতি, জনগণের বেদনা, জনগণের ক্ষতির প্রতি সরকার দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং খামখেয়ালি আচরণ করেছে।