Image description
ট্রাম্প প্রশাসনের পালটা ৩৫% শুল্ক আরোপ । তৃতীয় দফা বৈঠকের জন্য ২৬-২৭ জুলাই সময় চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যদিও এর আগে ইউএসটিআর চিঠি দিয়ে তাদের ব্যস্ততার কথা জানিয়েছে । 

ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর জন্য ‘বাংলাদেশের চূড়ান্ত অবস্থানপত্র’ মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরে (ইউএসটিআর) পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূরীকরণসহ নানা ইস্যুতে একমত হওয়া বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনার জন্য ইউএসটিআরের কাছে ২৬-২৭ জুলাই আবারও সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। অবস্থানপত্র এবং সময় চাওয়ার প্রস্তাব দুটি ই-মেইলে পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এর আগে আলোচনার বিষয়ে সময় চাওয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্র তা দেয়নি। সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আসা এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, ইউএসটিআর বর্তমানে খুব ব্যস্ত সময় পার করছে। ফলে সংস্থাটির পক্ষে সময় দেওয়া কঠিন। এজন্য তারা সময় চূড়ান্ত করে আসার জন্য ঢাকাকে অনুরোধ করেছে।

এদিকে বাংলাদেশের অবস্থানপত্র চূড়ান্ত করতে সোমবার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক আহ্বান করেন। এতে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের অবস্থানপত্রের সঙ্গে আমরা তৃতীয় দফা আলোচনার সময় চেয়ে ইউএসটিআরের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। আগামী সপ্তাহে সময় চাওয়া হয়েছে, আলোচনার জন্য এটি একটি অনুকূল সময়। এখন বিষয়টি ইউএসটিআরের ওপর নির্ভর করছে।

বাড়তি শুল্ক কমানোর বিষয়ে ইউএসটিআরের সঙ্গে ৯-১১ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসিতে বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষ হয়। ইউএসটিআরের সঙ্গে প্রথমে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা লুৎফে সিদ্দিকী এবং পরে নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। শেষ ধাপে ৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এর মধ্যে ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি চিঠি পাঠিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়ে দেন বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা পালটা শুল্কের হার ৩৭ শতাংশ হবে না, এটা হবে ৩৫ শতাংশ। তবে ইউএসটিআরের সঙ্গে শুল্ক কমাতে দুই দফায় আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেও সাফল্য পায়নি বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল।

এদিকে বৈঠক শেষে দেশে ফিরে ১৪ জুলাই অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) থাকার কারণে তিনি খোলামেলা আলোচনা করতে পারেননি। ফলে উপস্থিত অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা ভালো কোনো পরামর্শও দিতে পারেননি।

উল্লেখ করা যেতে পারে, জুনের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ হঠাৎ নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট বা অপ্রকাশিত চুক্তি করে। এ কারণে দেশটির সঙ্গে আলোচনার কোনো বিষয় সরকার প্রকাশ করতে পারছে না।

ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান যুগান্তরকে জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের ডাকলেও ইউএসটিআরের সঙ্গে কি আলোচনা হয়েছে সেটি পরিষ্কারভাবে বলা হয়নি। যে কারণে আমরাও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারিনি।

এদিকে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষে তৃতীয় দফা আলোচনার জন্য প্রথমে ইউএসটিআরের কাছে চিঠি দিয়ে সময় চেয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেটির জবাবে ইউএসটিআর জানিয়েছে, এ সময়ে সংস্থাটির কর্মকর্তারা এত ব্যস্ত যে তাদের পক্ষে সময় বের করা কঠিন। ফলে বাংলাদেশ যেন তাদের কাছ থেকে সময় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে আসে, এটি ইউএসটিআরের চাওয়া। ফলে তৃতীয় দফা আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের পালটা শুল্কহার কিভাবে কমানো হবে, তা নিয়েও গভীর সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ পূর্বঘোষণা অনুযায়ী পহেলা আগস্ট থেকে বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা রয়েছে। এ হিসাবে আর মাত্র হাতে সময় আছে ৮ দিন।

অপরদিকে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যারা লবিস্ট হিসাবে কাজ করছেন তাদের অনেকে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়ে গেছেন অন্যান্য দেশের সঙ্গে। ফলে বাংলাদেশের জন্য লবিস্ট পাওয়াও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান যুগান্তরকে বলেন, ‘আগামী কয়েকটি দিন খুব ইতিবাচক কিছু পাওয়া কঠিন। তারপরও লবিস্ট নিয়োগ করতে চাই। কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিটা চালু রাখতে চাই আমরা।’

যুক্তরাষ্ট্র ২ এপ্রিল ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করে বাংলাদেশের ওপর। পরে ৩ মাসের জন্য এই শুল্ক আরোপ স্থগিত করে। এই স্থগিতাবস্থায় সবার জন্য বেজলাইন হিসাবে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এরপর আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ৭ জুলাই সবমিলে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়, যা পহেলা আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। তবে পালটা শুল্কের হার কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি পেতে বাংলাদেশ মার্কিন পণ্য আমদানি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে ৭ লাখ টন গম আমদানির জন্য রোববার সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করা হয়েছে। আবার যেসব পণ্য আমদানি করা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে, সেগুলোর ওপর শুল্ক প্রায় শতভাগ প্রত্যাহারের পক্ষেও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন, তেলবীজ, ডাল, চিনি ও বার্লি আমদানির পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। অন্যান্য আমদানির মধ্যে থাকছে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ, এলএনজি, সামরিক সরঞ্জাম।

আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক : অবস্থানপত্র পাঠানোর আগে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের শর্তে বাংলাদেশ ছাড় পেতে মার্কিন পণ্যের শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি ওয়াশিংটনের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বাণিজ্যসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া ভিন্ন কোনো শর্তে রাজি হবে না ঢাকা। বৈঠকে এক ডজনের বেশি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো এবং এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় নীতিগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনা।