
তামাক নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করতে আন্তর্জাতিক চুক্তি ‘এফসিটিসি’র শর্ত ভেঙে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারের (তামাক কোম্পানি) সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার গঠিত এ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। খসড়াটি পর্যালোচনার শেষ পর্যায়ে এসে পুনরায় এর ওপর তামাক কোম্পানিগুলোর মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ‘খসড়া পরিমার্জনসংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি’র বৈঠকে। যা ১৩ জুলাই অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক চুক্তি ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)’-এর ধারা ৫.৩-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ওই ধারায় বলা আছে-এ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর তামাক কোম্পানির ব্যবসায়িক ও অন্যান্য স্বার্থ থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ও পদক্ষেপগুলো সুরক্ষিত রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশেষ করে তামাক কোম্পানি বা তাদের সহযোগিতায় প্রণীত কোনো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বা নীতির খসড়া বা সহায়তার প্রস্তাব সরকার গ্রহণ, সমর্থন বা অনুমোদন করতে পারবে না।
সেখানে আরও বলা আছে, ‘তামাক শিল্পের স্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য নীতির স্বার্থের মধ্যে মৌলিক ও আপসহীন সংঘর্ষ রয়েছে।’ কারণ, একটি পক্ষ চায় তামাক পণ্যের বিস্তার ও মুনাফা, আর অন্য পক্ষের লক্ষ্য সেই পণ্যজনিত ক্ষতি থেকে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
এফসিটিসি হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক চুক্তি, যেখানে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে সই করেছে।
বৈঠকে উপস্থিত এমন একটি সূত্র জানায়, তামাক নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের খসড়ার ওপর তামাক কোম্পানিগুলোর মতামত নেওয়ার প্রসঙ্গ এলে সেখানে উপস্থিত উপদেষ্টা কমিটির একাধিক সদস্য এর বিরোধিতাও করেছেন। তামাকবিরোধী বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের যুগান্তরকে বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক আইন তৈরিতে তামাক কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা ও মতামত গ্রহণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি অ্যার্টিকেল ৫.৩ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জানা গেছে, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে ২০২১ সালে এর সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত, ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ এবং অংশীজনদের মতামত নেওয়া হলেও তা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। নানা অজুহাত ও অদৃশ্য হস্তক্ষেপের কারণে ২০২১-২০২৪ এর জুন পর্যন্ত এর সংশোধনী আনতে ব্যর্থ হয়েছে বিগত সরকার। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার এসে সংশোধনী আইনটি অধ্যাদেশ আকারে দ্রুত চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেয়। সে লক্ষ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের খসড়ার ওপর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে ৭ নভেম্বর অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করা হয়। কিন্তু সেখানে খসড়ার অনুমোদনের বিপরীতে এটি পর্যালোচনা করতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। ওই কমিটির নাম দেওয়া হয় ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া পরিমার্জনের জন্য গঠিত উপদেষ্টা কমিটি। যার প্রধান হচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা।
বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রমতে, উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এ অধ্যাদেশের খসড়ার ওপর বিস্তর আলোচনা হয়। সেখানে সভাপতির বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা অবশ্যই জরুরি, কিন্তু সংশোধনের ফলে সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব পড়বে সেগুলোও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। দেশে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে কোনো ইলাস্টিক রেভিনিউ সোর্স নেই। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাজস্ব আয়ের ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বিকল্প পথও খুঁজতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের (তামাক কোম্পানি) মতামত গ্রহণ ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।’
এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বৈঠকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক বৈশ্বিক চুক্তি এফসিটিসিতে বলা আছে-স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে তামাক কোম্পানি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর পরামর্শ/মতামত গ্রহণের বিষয়টি স্বার্থের সংঘাতের পর্যায়ে পড়বে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এ মতামতকে সমর্থন করে সেখানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ অনুসারে সরকার তামাক কোম্পানির সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে না।
এ সময় অর্থ উপদেষ্টা আরেক দফা বলেন, তামাক কোম্পানি বা এ সংশ্লিষ্ট কারও বক্তব্য শুনলেই তা গ্রহণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু রাজস্ব আদায় যেন ব্যাহত না হয়, সে বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব না পড়লে প্রস্তাবিত ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর অনুমোদনের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো আপত্তি থাকার সুযোগ নেই। যে কারণে অধ্যাদেশটির বিষয়ে সব পক্ষের (তামাক কোম্পানি) বক্তব্য গ্রহণ আবশ্যক উল্লেখ করে তিনি এ কমিটির সম্মানিত সদস্যরাসহ একটি স্টেকহোল্ডার সভা আহ্বানের নির্দেশ দেন।
বৈঠকের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী খসড়ার ‘৬ছ’ এবং ‘১০(১)’-এর প্রস্তাব দুটি পুনঃবিবেচনা করার প্রয়োজন। সেখানে তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে মিষ্টি দ্রব্য, মশলা, সুগন্ধি (ফ্লেভার), আসক্তিমূলক দ্রব্য, রং ব্যবহার নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ফ্লেভারিংয়ের মাধ্যমেই সিগারেটের মূল্যস্তর ভাগ করা হয়। এটি নিষিদ্ধ করা হলে মূল্যস্তর বিন্যাস এবং রাজস্ব আদায় ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে অধ্যাদেশ থেকে ‘সুগন্ধি (ফ্লেভার)’ শব্দগুলো বিলুপ্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান আইনে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার উভয় পাশের নিচ থেকে উপরের দিকে ৫০ শতাংশ সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর স্থানে সংশোধনীতে ৯০ শতাংশ উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে প্যাকেটের গায়ে নিরাপত্তা চিহ্ন, রাজস্ব স্ট্যাম্প, কোম্পানির লোগো, ব্র্যান্ড লাগানোর স্থান সংকীর্ণ হয়ে যাবে। এতে সব নিরাপত্তা চিহ্ন ব্যাতিরেকে সহজেই নকল প্যাকেট তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। ফলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ৫০ শতাংশ থেকে উন্নীত করে ৭৫ শতাংশ করা যেতে পারে।
এনবিআর চেয়ারম্যানের উপস্থাপিত বিষয় দুটি যৌক্তিক এবং সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত সংশোধনীর সংশ্লিষ্ট অংশটুকু সংশোধন করা যেতে পারে বলে ওই বৈঠকে মত দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা। তিনি আরও বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোর এবং স্বল্প আয়ের মানুষদের নিকট তামাক পণ্যের সহজলভ্যতাসহ নতুন ধূমপায়ী সৃষ্টি রোধে খুচরা শলাকা বা খোলা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধকরণের প্রস্তাবনাটি যুগোপযোগী ও প্রয়োজনীয়। এ সময় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, প্রস্তাবিত আইনে ই-সিগারেট নিষিদ্ধের বিষয়টি বহাল রাখা দরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ই-সিগারেট ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ এবং এ বিষয়টি আইনে যুক্ত করতে এনবিআরের তরফ থেকে কোনো আপত্তি নেই।
বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তামাক কোম্পানিগুলোর সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়টি আইনে রাখা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীর নতুন সংযোজন হিসাবে খুচরা শলাকা বা খোলা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধকরণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা হবে কিনা এ বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যান। পঙ্গুত্ববরণ করেন চার লাখের বেশি মানুষ।