Image description
বাসাবো-ফার্মগেট রুট

ঢাকার গণপরিবহনে চলছে প্রকাশ্যে ‘ডাকাতি’। শহরের ভেতরে চলাচলকারী বিভিন্ন রুটের বাস ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছে। তাদের সর্বশেষ ভাড়া আদায়ের চার্ট করে দেয়া হলেও কেউই মানছে না তা। প্রথম কয়েকদিন  বাসের ভিতরে সেই চার্ট ব্যবহার হয়েছে। তারপরই উধাও। ফলে তারা দশ টাকার ভাড়া পনেরো টাকা। পনেরো টাকার ভাড়া বিশ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চার বা পাঁচ কিলোমিটার পথের ভাড়া জোর করে আদায় করছে ২৫ টাকা। চার্ট করে দেয়ার পর ঘোষণা করা হয়েছিল ঢাকা শহরের ভিতরে কোনো বাসের চেক থাকবে না। কিন্তু এসব গণপরিবহন সেই চেকই চালু করেছে। সরকার অনুমোদিত না হলেও চেকের দোহাই দিয়ে  সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পকেট কেটে নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে দেখার কেউ নেই। এ নিয়ে কথা হয় বাসমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, চার্ট অনুযায়ী ভাড়া নিতে হবে। অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। ঠিক ওই সময় এই প্রতিবেদক একজন কন্ডাক্টরকে ফোনে ধরিয়ে দেন। সে সাইফুল ইসলামকে জানিয়ে দেয়, তারা ভাড়ার চার্ট গাড়ির গ্লাসে লাগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু পাবলিক ছিঁড়ে ফেলেছে। আসলে কি তাই? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব চার্ট গাড়ির গ্লাসে বা গাড়িতেই নেই। যার কারণ, তারা যাত্রীকে ফাঁদে ফেলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। এক্ষেত্রে সবথেকে এগিয়ে সাইনবোর্ড থেকে সাভারগামী বা বিপরীতগামী লাব্বাইক ও এমএম লাভলী পরিবহন। তারা অযৌক্তিক এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। 

বাসাবো থেকে বাংলামোটরের ভাড়া চার্টে ১২ টাকা থাকলেও তারা যাত্রীর কাছ থেকে ১৫ টাকা আদায় করে জোর করে। আবার খিলগাঁও পুলিশ ফাঁড়ি, মালিবাগ থেকে তাদের পরিবহনে উঠলেও ১৫ টাকা আদায় করা হয়। অথচ চার্টে মালিবাগ থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ১০ টাকা। বাসাবো থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া ১৫ টাকা। আবার মালিবাগ মোড় থেকে কল্যাণপুরের ভাড়া ২০ টাকা, কলেজগেটের ভাড়া ১৬ টাকা হলেও যাত্রীর কাছ থেকে এ দু’টি পরিবহনের কন্ডাক্টররা আদায় করছে ৩০ টাকা। মালিবাগ থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ১০ টাকা। আবার ফার্মগেট থেকে গাবতলীর ভাড়া ১৬ টাকা। কিন্তু কোনো যাত্রী মালিবাগ, মগবাজার থেকে এ পরিবহনে উঠে যদি আসাদগেট নামেন, কলেজগেট নামেন, কল্যাণপুর নামেন- তাহলে তার কাছ থেকে জোরজবরদস্তি করে আদায় করা হচ্ছে ৩০ টাকা। মালিবাগ থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু মালিবাগ থেকে আসাদগেটে নামলে কেন ভাড়া ৩০ টাকা? এ প্রশ্নের উত্তরে কন্ডাক্টর আনোয়ারের জবাব ফার্মগেটের পরে চেক আছে। এই চেকের দোহাই দিয়ে ফার্মগেট থেকে আসাদগেটের ভাড়া ১৫ টাকা বা ২০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ এই পথের দূরত্ব সর্বোচ্চ দুই কিলোমিটার। শুধু লাব্বাইক, লাভলীই নয়- ফার্মগেট থেকে গাবতলী পর্যন্ত গাবতলী পরিবহন (৮-নম্বর বাস) আদায় করছে ২০ টাকা ভাড়া। এভাবে প্রতিদিন কত লাখ বা কত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। এমন হয়রানির শিকার একজন নারী সম্প্রতি প্রতিবাদ করেন। তাকে তুই তুকারি করে অপমান করেন কন্ডাক্টর। কিন্তু গাড়িতে থাকা কোনো যাত্রী তার প্রতিবাদ করেন না। ওই নারীর অভিযোগ যাত্রীদের এই নীরবতার কারণেই আরও প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে গণপরিবহনের শ্রমিকরা। তারা মানুষকে মানুষ মনে করে না। 

একই রকম অভিযোগ করেন আলমগীর হোসেন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তার সন্তান পড়ে মহাখালি বিএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। প্রতিদিন আগারগাঁও রেডিও স্টেশন থেকে তিনি সন্তানকে স্কুলে দিতে ওঠেন ভূঁইয়া পরিবহনে। এই বাস পুরাতন বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে দিয়ে জাহাঙ্গীরগেট হয়ে যায়। রেডিও স্টেশন থেকে বিএফ শাহীন স্কুলের দূরত্ব সর্বোচ্চ যদি ৪ কিলোমিটারও ধরা হয়, তবু তার কাছ থেকে আদায় করা হয় ২৫ টাকা। কেন এমনটা? এর কোনো উত্তর নেই। আলমগীর স্বল্প বেতনে চাকরি করেন। কিন্তু সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন বড়। তাই বাধ্য হয়ে তাকে এ পথে চলাচল করতে হয়। এমনই চিত্র প্রতিটি রুটের। এ অনিয়ম দেখার কেউ নেই। হানিফ নামের একজন যাত্রী বললেন- এটা স্রেফ প্রকাশ্যে গণডাকাতি। এটা দেখার কেউ নেই। 

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে শোচনীয় রুট সাইনবোর্ড থেকে বাসাবো, মালিবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেট হয়ে চলাচল করা যাত্রীদের। কারণ, এই রুটে মাত্র দু’টি পরিবহন চলাচল করে। একটি লাব্বাইক। অন্যটি এমএম লাভলী। তাদের বাসের সংখ্যা অনেক কম। ফলে দিন বা রাতের যেকোনো সময় রাস্তায় বাসের প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করেন শত শত যাত্রী। সকালে অফিস টাইমে এই বাসে উঠতে পারাকে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে’ জয় পাওয়া বলে আখ্যায়িত করেন যাত্রী মাঈনুল। অন্য রুটে, বিশেষ করে উত্তরার রুটে অসীম পরিমাণ গাড়ি। চলে রাইদা, তুরাগ, অনাবিল সহ অসংখ্য গাড়ি। এসব গাড়ি একটির পিছনে একটি আসতেই থাকে। ফলে যাত্রীর চাপ হলেও তা সঙ্গে সঙ্গে মিটে যায়। কিন্তু লাব্বাইক ও লাভলীর সংখ্যা এত কম যে, যাত্রীদের এসব বাসে উঠতে হলে শক্তির পরীক্ষা দিতে হয়। ফলে অবমাননাকর অবস্থার শিকার হন নারী, যুবতী, ছাত্রীরা। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন কেউ না কেউ বাসে উঠতে গিয়ে বা বাসের ভিতরে যাত্রীর চাপাচাপিতে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ সহ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হারাননি। দশ মিনিট, কখনো বিশ মিনিট পর বাস আসে। তখন তা এতটাই ভরা থাকে যে, বাইরে থেকে সূঁচটা রাখাও কঠিন হয়। 

আবার অনেক বাস তখন বাসাবো, খিলগাঁওয়ে থামেও না। ফলে মানিকনগর, বাসাবো, খিলগাঁওয়ের যাত্রীদেরকে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যিনি শক্তির পরীক্ষায় পাস করেন, তিনি জোর করে বাসে উঠতে পারেন। যিনি দুর্বল, তিনি থেকে যান। সঙ্গে সঙ্গে তার ভিতর অফিসে বিলম্ব হওয়ার টেনশন কাজ করতে থাকে। অভিযোগ আছে, এই রুটে অন্য কোনো পরিবহনও নামতে দেয়া হয় না। আগে তালুকদার নামে একটি পরিবহন চলতো। তা অদৃশ্য এক শক্তির বলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যাত্রীরা দাবি জানিয়েছেন, অবিলম্বে এই রুটে গাড়ির সংখ্যা বাড়াতে অথবা অন্য কোনো পরিবহন এই রুটে যোগ করতে।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে একজন বাসমালিক বলেন, তারাও চার্টের বাইরে ভাড়া নেয়ার পক্ষে নন। তার কথায়- কোন পাপে যে এই ব্যবসায় ঢুকেছিলাম। বাসে যাত্রীর অতিরিক্ত চাপ থাকা সত্ত্বেও কন্ডাক্টর বা চালকরা তাদের সঙ্গে টালবাহানা করে। চেক অনুমোদিত না হলেও চেকার শুধু বাসের সিট হিসাব করে। দাঁড়ানো যাত্রীর কোনো হিসাব নেই। এসব যাত্রীর কোনো ভাড়া মালিক পান না। অন্যদিকে চেকার গাড়িতে ওঠেনও না অনেক সময়। তাদেরকে দশ টাকার চেকে বিশ টাকা ধরিয়ে দিলেই ওয়েবিল পর্যন্ত লেখেন না। ওই বাসমালিক বলেন, আপনারা একটু লেখেন। আমাদের বাঁচান। এসব শ্রমিক আমাদের শেষ করে দিচ্ছে।