Image description
রাজধানীতে অপরাধ

ঢাকার রাস্তায় হাঁটলে যে চিত্র চোখে পড়ে, তা রিকশার সারি। ঘণ্টার টিং টিং আওয়াজ, চালকের হাঁকডাক, আর যাত্রীর গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া। এক সময় এই বাহন ছিল শহুরে জীবনের সবচেয়ে নিরীহ ও নির্ভরযোগ্য যান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নগরবাসীর জন্য এই রিকশাই হয়ে উঠেছে এক ভয়ংকর মরণফাঁদ। রাজধানীজুড়ে ছিনতাইয়ের কৌশল বদলে গেছে, আর তার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে রিকশা। চালকবেশে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা কৌশলে লুটে নিচ্ছে সাধারণ নাগরিকের সর্বস্ব।

এমনই এক ছিনতাইয়ের ভুক্তভোগী হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র রিমন হোসেন মণ্ডল। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় বন্ধুর বাসা থেকে ভোরবেলা রওনা দেন ঢাবি ক্যাম্পাসের উদ্দেশে। কোনো যানবাহন না থানায় হেঁটেই চলছিলেন তিনি। এ সময় হঠাৎ করে পেছন থেকে তিন কিশোর চাপাতি নিয়ে এসে গলায় এবং পেটের কাছে ধরে। এরপর মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এই ঘটনাটি যখন ঘটছিল, তখন একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কয়েকবার এসে ওই রাস্তার সামনে দিয়ে ঘুরতে থাকে। এরপর ছিনতাই শেষে ওই রিকশায় করেই ছিনতাইকারীরা চলে যায়। এরপর রাশেদ নিজেই মোহাম্মদপুর থানায় অভিযোগ করলেও চালক এবং অন্য ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

এমন আরেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের মুখে। ৩ জুলাই রাত তখন প্রায় দেড়টা। উত্তরা ব্যাংকের গলির সামনে রিকশা দিয়ে এক লোক যাচ্ছিলেন। হঠাৎ রিকশাটি থেমে গেলে দুজন চাপাতি নিয়ে ওই লোককে ঘিরে ধরে। এরপর তার সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে রিকশা থেকে নামিয়ে ওই রিকশায় উঠে চলে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নাইমুর রহমান নাইম কালবেলাকে বলেন, আমার সেদিন বাসায় যেতে যেতে রাত হয়ে গিয়েছিল। আমি বাসার সামনেই ছিলাম। হুট করে দেখলাম কয়েকটা লোক এসে চাপাতি নিয়ে সব ছিনতাই করে চলে গেল। রিকশাওয়ালা নিজেই যে ছিনতাইকারী ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি একা ছিলাম, তাই এত রাতে ওই লোকটার জন্য কিছুই করতে পারিনি।

শুধু রাত নয়, ভর সন্ধ্যায় এবং দিনের আলোতেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে রিকশায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছ, বেশ কয়েক মাস ধরে ছিনতাইয়ের একটি কৌশল হয়েছে ‘রিকশা ট্র্যাপ’। এতে মূলত তিনজনের একটি সংঘবদ্ধ দল কাজ করে—রিকশাচালক, যাত্রীবেশে থাকা অপরাধী এবং রাস্তায় অপেক্ষমাণ সহযোগীরা। কখনো রিকশার পেছনে সঙ্গী সেজে ওঠে ছিনতাইকারী, আবার কখনো সামনে বা পাশ থেকে এসে ছিনতাই করে সব নিয়ে চলে যায়। রিকশায় চালকবেশে থাকা ছিনতাইকারী তার টার্গেট এলাকায় যাত্রী নিয়ে আগে থেকেই সেখানে থাকা তার সঙ্গীদের নিয়ে এই কাজ করে। কয়েকজন ছিনতাইকারী ধরাও পড়েছে। তাদের কাছ থেকেও এমন কৌশলের কথা জানা গেছে।

রিকশাচালকদের মাধ্যমে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন—এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী কালবেলাকে বলেছেন, রিকশায় ওঠার পর হঠাৎ চালক গলি বা নির্জন পথে রিকশা ঘুরিয়ে নেয়। একপর্যায়ে যাত্রীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা, মোবাইল ফোন বা গহনা লুটে নেয় তারা। প্রতিরোধের চেষ্টা করলেই মারধর, এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ছিনতাইয়ের ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অনেক রিকশাচালকই চক্রের সদস্য। কেউ কেউ আবার দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়ায় রিকশা চালায় এবং নির্দিষ্ট এলাকা বেছে অপরাধ সংঘটিত করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, এসব ছিনতাই প্রতিরোধে বেশকিছু করণীয় রয়েছে। প্রতিটি রিকশায় চালকের ছবি, নামসহ নিবন্ধন নম্বর দৃশ্যমান রাখার নির্দেশনা জারি করা। রাতে নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া রিকশা চলাচলে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা। রিকশায় জিপিএস ট্র্যাকার ও কিউআর কোডও চালু করা যায়। এসবের মাধ্যমে এ ধরনের ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে স্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব।

রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, রিকশায় চড়ে অবাধে সব জায়গায় চলাচলের কারণে অপরাধীরা এই বাহনটিকে মাঝে মাঝে ব্যবহার করে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অভাবের কারণে অনেক সময় কিছু চালক অপরাধ চক্রের সঙ্গে মিশে যায়। এই অপরাধ কমানোর ক্ষেত্রে সব রিকশাচালকের নিবন্ধনের কোনো বিকল্প নেই। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এই দাবি জানিয়ে আসছি।

ছিনতাইয়ের ভয়ে নগরবাসীর একাংশ এখন রিকশা ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে রাতের পর শহরের ভেতরে চলাফেরা করা নারীদের জন্য এই ভয় আরও প্রকট। বয়স্ক, শিক্ষার্থী, অফিস যাত্রী, এমনকি হাসপাতালের পথের যাত্রীও এখন নিরাপদ নন। মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা সুরাইয়া খানম বলেন, আমার বাসা গোপীবাগ এলাকায়। বাসা একটু ভেতরে হওয়ায় একটা অন্ধকার গলির মধ্য দিয়ে রিকশা নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু রাস্তাটি খুব নির্জন থাকায় এখন রিকশা দিয়ে চলাচল কমিয়ে দিয়েছি। আমার ভাই মোটরসাইকেলে আমাকে বাসায় দিয়ে আসে। আমার এই সুবিধা থাকায় এখন আর রিকশায় উঠি না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রিকশাচালকদের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই বা নিবন্ধনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে অপরাধের পর চালক বা রিকশা চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের ডিসি মো. শাহরিয়ার আলী বলেন, আমার এলাকায় পুলিশের নিয়মিত টহল অভিযান চলছে। চালকবেশে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে অবশ্যই দায়িত্ব নিয়ে সেটি তদন্ত করে এসব চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। একসময় মোটরসাইকেল নিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজান বলেন, ছিনতাইসহ যে কোনো অপরাধের বিষয়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছে। রিকশাচালক ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য হয়ে থাকলে, এমন নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।