
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টা। গোপালগঞ্জ লাগোয়া গ্রামের একটি বাড়ির সদর দরজায় চার যুবকের আড্ডা। গল্পের বিষয় জেলায় চলমান কারফিউ। কাছে গিয়ে জানা যায়, তাদের ভয়-আতঙ্কের কথাও। আড্ডারত যুবকরা জানান, বাড়িতে একজন পুরুষও রাতে থাকেন না। তাদের দাবি, কোনো অপরাধ না করা সত্ত্বেও পুলিশ বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাই নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে বাড়ির বাইরে অবস্থান করতে হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির গোপালগঞ্জ পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সহিংসতার জেরে জেলা প্রশাসনের জারি করা চলমান কারফিউতে শহরের পাশাপাশি গ্রামেও স্থবিরতা নেমে এসেছে। শুক্রবার গোপালগঞ্জ সদর ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামে ঘুরে জানা যায়, পুরুষরা রাত হলেই বাইরে অবস্থান করেন। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের বাইরে অবস্থান করতে হয়। কেউ কেউ দিনেও বাড়ি থাকেন না। আশপাশের অন্য গ্রামে গিয়ে অবস্থান করেন।
গ্রামবাসীর দাবি, ঘটনার দিন গোপালগঞ্জ শহরে কেউ না গেলেও রাতের বেলা পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা বাড়িতে থাকছেন না। ফলে বাড়িতে অবস্থান করা নারী ও শিশুরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
গোপালগঞ্জ শহর সংলগ্ন ঘোষেরচর গ্রামের মামুন শেখ ও আক্কাস মোল্লা মানবজমিনকে বলেন, আমাদের গ্রামের একটা পুরুষও বাড়িতে থাকতে পারছে না। সবসময়ই মহিলারা ভয়ে ও আতঙ্কে থাকছে- কখন কাকে তুলে নিয়ে যায়। ওই এলাকার বাবু নামে এক ব্যক্তি বলেন, রাত হলে কেউ বাড়িতে থাকে না। আর আমার বাড়িতে এখন দিনের বেলাতেই পুরুষ কেউ নেই। তিনি জানান, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো মামলা নেই, তারপরও ধরে নিয়ে যায়। আর একবার নিলে তো ছাড়াছাড়ি নেই।
গোপালগঞ্জ সদরের মাঝিগাতী ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের মাসুম কাজী, নজরুল শেখ ও সিরাজ মিয়ার মুখে একই সুর, আতঙ্ক। রাত হলেই ওই গ্রামে যৌথবাহিনীর টহল টিম প্রবেশ করে। বৃহস্পতিবার রাতে ওই গ্রাম থেকে আনিস কাজী নামে এক ব্যক্তিকে ধরে নেয়ার কথা বলেন তারা। কাঠি গ্রামের মিশকাত মোল্লা জানান, ঘটনা ঘটিয়েছে এনসিপি ও আওয়ামী লীগ, ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। প্রশাসনের উচিত যাচাই-বাছাই করে গ্রেপ্তার করা। এছাড়াও পুলিশের গাড়ি পোড়ানো হয়েছে যে গ্রামে সেই খাটিয়াগড় গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি। প্রতি রাতেই পুলিশ হানা দিচ্ছে বলে গ্রামের রোজিনা বেগম ও শম্পা আক্তার দাবি করেন।
শম্পা বলেন, আমার বাড়িতে পুরুষরা সবাই বাইরে থাকে। রাত হলে তো পুলিশ আসে। আমার স্বামী কোনো অন্যায় করেনি। তারপরও ভয়ে চলে যায়। তিনি আরও বলেন, আমরা মেয়েরা এমনিই ভয় পায়।
যেমন ছিল শহরের চিত্র: দ্বিতীয় দিনের ১৯ ঘণ্টার কারফিউতে শহরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চালিয়েছে কঠোর নজরদারি। জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধের দোকান ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে দেয়া হয়নি। পৌর সড়কগুলোতে চলতে দেওয়া হয়নি রিকশা-অটোসহ অন্যান্য যানবাহন। সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হওয়া সকল মানুষকেই জিজ্ঞাসাবাদে তল্লাশি করা হয়। উপযুক্ত কারণ দেখাতে না পারলে বাড়িতে ফেরত পাঠায়। রাত ১০টার পর পুরোপুরি চুপচাপ হয়ে পড়ে শহর।
বিসিক ব্রিজ এলাকায় দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কঠোর নজরদারিতে আছি। কেউ রাস্তায় এলেই জিজ্ঞাসাবাদ করে ফেরত পাঠাচ্ছি। আর জরুরি প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে দিচ্ছি।
কারফিউ চলবে শনিবার: এদিকে, আজ শনিবার পর্যন্ত আবারও কারফিউর সময় বাড়িয়েছেন গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক। শুক্রবার বিকালে এক লিখিত নির্দেশনায় এ করফিউ জারি করা হয়। এনিয়ে মোট দ্বিতীয় দফায় কারফিউর মেয়াদ বাড়ানো হলো।
নতুন করে জেলায় নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড মোতায়েন: সেনাবাহিনী, বিজিবি’র পর গোপালগঞ্জ জেলায় শুক্রবার দুপুর থেকে নতুন করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের উপস্থিতি দেখা গেছে। মধুমতি নদীতে ওই দুই বাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে টহলের পাশাপাশি পানিপথে চলাচল করা সকল নৌকা ও ট্রলারে তল্লাশি চালিয়েছে।
পুলিশের মামলায় আসামি প্রায় ৫০০: গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি)’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করার ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ ও ৪০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক আহম্মেদ আলী বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মামলাটি করেন। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মো. সাজেদুর রহমান বিষয়টি মানবজমিনকে মোবাইল ফোনে নিশ্চিত করেছেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, এনসিপি’র কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ ও সহিংসতা চালানো হয়। এসব ঘটনার পর গোপালগঞ্জে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
উল্লেখ্য, গত বুধবার গোপালগঞ্জে এনসিপি’র ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’কে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের পর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ৪জন কর্মী-সমর্থক নিহত হন। পাশাপাশি প্রায় দুই শতাধিক আহত হন।
এ ঘটনার পর প্রথমে স্থানীয় প্রশাসন বিকালে ১৪৪ ধারা জারি করে। পরে পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে এদিন রাত ৮টা থেকে কারফিউ জারি করা করে। ওই কারফিউ পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মোট ২২ ঘণ্টা বলবৎ ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র মানবজমিনকে নিশ্চিত করেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে মুখ খোলেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার এম. রকিবুল হাসান বলেন, অবশ্যই সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়েই জেলা প্রশাসক সান্ধ্য আইন বা কারফিউ জারি করেছেন। গোপালগঞ্জবাসী ঝুঁকিমুক্ত হলে নিশ্চয়ই কারফিউ তুলে নেবেন।