
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের সহিংস হামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ অন্তত ছয়জন নিহত হন। এদিন আবু সাঈদকে স্মরণ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি আবু সাঈদকে স্মরণ করে বলেছেন, ‘নায়কেরা মরে না, তারা আমাদের আশীর্বাদ দিয়ে যান সবসময়।’ আজ বুধবার (১৬ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের নিজ অ্যাকাউন্টে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি এ মন্তব্য করেন। এ স্ট্যাটাসে তিনি আবু সাঈদের ফেসবুক প্রোফাইলের স্ক্রিনশট যুক্ত করেন।
গত বছরের এ দিনে শিক্ষার্থীদের সারাদেশে বর্বরতম হামলার ঘটনায় আবু সাঈদরা শহীদ হওয়ার পর ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-জনতার মাঝে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দ্রুতই গণআন্দোলনের রূপ নিতে থাকে। হামলার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ছয় জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করে। একইসঙ্গে দেশের সকল স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থান করা নিষিদ্ধ করে অবিলম্বে হল ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্থগিত করা হয় ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই সারাদেশে ফের ছাত্রলীগের হামলা শুরু হয়, যার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও মারমুখী অবস্থানে থেকে দমন অভিযান শুরু করে।
রংপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম মুখ আবু সাঈদ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, ১৬ জুলাই বিকেলে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হলে পুলিশ প্রথমে টিয়ার গ্যাস ছোড়ে, এরপর শুরু করে লাঠিচার্জ। পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। তখন আবু সাঈদ দুই হাত মেলে বুক পেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান। সেই মুহূর্তে মাত্র ১৫ মিটার দূর থেকে দুই পুলিশ সদস্য শটগান দিয়ে তার ওপর গুলি চালান। ভিডিওচিত্র সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই দেশব্যাপী ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, শুরু হয় আরও ব্যাপক আন্দোলন।
১৬ জুলাইয়ের ওই হামলার দিন ঢাকাতেও একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। রাজধানীর ঢাকা কলেজ ও সায়েন্সল্যাব এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন দুই যুবক— বলাকা সিনেমা হলের সামনে অস্থায়ী দোকানের হকার মো. শাহজাহান (২৪) এবং নীলফামারী সদরের বাসিন্দা বাদশা আলী ও সূর্য বানুর ছেলে সাবুজ আলী (২৫)।
এদিন সকাল থেকেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েন্সল্যাব, প্রগতি সরণি, শান্তিনগর, বাড্ডা, মতিঝিল শাপলা চত্বর, তাঁতীবাজার, উত্তরা ও বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। মহাখালীতে শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করায় ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন চলাচল ছয় ঘণ্টা বন্ধ থাকে। পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে শিক্ষার্থীরা যান চলাচল বন্ধ রাখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ওই দিন ছাত্রলীগ এবং কোটা আন্দোলনকারীরা পৃথক স্থানে সমাবেশ করলেও, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। বিশেষ করে ঢাকা কলেজ ও সায়েন্সল্যাব এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সংঘর্ষের খবর আসে চানখারপুল, রায়সাহেব বাজার, প্রগতি সরণি, ভাটারা, মিরপুর-১০ ও ফার্মগেট থেকেও।
ভাটারা এলাকায় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর পাওয়া যায়।
চট্টগ্রামেও পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। সেখানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে নিহত হন তিনজন— চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা ওয়াসিম আকরাম (২৪), ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ (২৪) এবং ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মো. ফারুক (৩২)।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ১৬ জুলাইয়ের ঘটনায় সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, ‘এটি ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট দমন-পীড়নের স্পষ্ট নমুনা।’ পরদিন ১৭ জুলাই দুপুর ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ঘোষণা করেন আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।
১৬ জুলাই রাতেই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায় সরকার ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও গাজীপুরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করে। একই দিনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে। শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগে বাধ্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
একইসঙ্গে দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
সরকারের পক্ষে ওইদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিজ নিজ ইউনিট অফিসে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং দলটি জানায়, তারা রাজনৈতিকভাবে এই আন্দোলনের মোকাবিলা করবে। একইদিন, কোটা বহাল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্টে ‘লিভ টু আপিল’ দায়ের করা হয়। এ আবেদনে বলা হয়, কোটা রাখা বা না রাখার বিষয়টি সরকারের নীতিগত এখতিয়ার, এতে আদালতের হস্তক্ষেপ চলতে পারে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান দেশের সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণের প্রতি। বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেয়। আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগের ভূমিকার প্রতিবাদে সংগঠনটির কয়েকজন নেতা পদত্যাগ করেন।
শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর হামলায় ১৬ জুলাই সন্ধ্যার পর পৃথক বিবৃতি দেয় পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন— অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সাউথ এশিয়া, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এবং সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক)। তারা এ হামলাকে ‘নিন্দনীয়, অগ্রহণযোগ্য ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন’ বলে আখ্যা দেয়।
একইসঙ্গে দেশের অন্তত ১১৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক যৌথ বিবৃতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানান। ১৯৯০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারাও এক বিবৃতিতে বর্তমান সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি জানান।
তথ্য সহায়ক: বাসস