Image description
প্রধান উপদেষ্টার ৫ সিদ্ধান্ত কার্যকরের নির্দেশ

দেশের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট কাটাতে বড় ধরনের সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আস্থাহীনতার কারণে বিগত ৮ বছরে কমপক্ষে ১৬ লাখ বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ লাখ বিনিয়োগকারী কোনোভাবে টিকে আছেন। দীর্ঘদিন ধরে স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি, ভালো শেয়ারের মূল্য বাড়তে না দেওয়া, বাজার নিয়ন্ত্রণে কমিশনের নিষ্ক্রিয়তাসহ বেশ কিছু কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

সম্প্রতি পুঁজিবাজারে গতি আনতে ৫টি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নসহ পুঁজিবাজারের বড় ধরনের সংস্কার নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগকে। বৈঠক সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। প্রধান উপদেষ্টার দিকনির্দেশনার মধ্যে আছে-‘সরকারি মালিকানাধীন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে সরকারের শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত’ এবং দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির জন্য উৎসাহিত করতে প্রণোদনাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি রুখতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ৩ মাসের মধ্যে বাজার সংস্কার, পুঁজিবাজারের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা কমাতে বড় কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।

জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, আগে পুঁজিবাজার দেখার কেউ ছিল না, কোনো অভিভাবক নেই। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজার পুরোপুরি মনিটরিং করা হচ্ছে। বাজার নিয়ে কোনো কথা থাকলে সেটি আমার কাছে বলতে পারছে। আগে কথা শোনার কেউ ছিল না। ব্রোকার হাউজের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা বলেছেন বাজারের যে চরিত্র সেটি এখন স্থিতিশীল এবং স্বাভাবিক। বাজার ভালো করার জন্য বেশকিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে বাজার পরিস্থিতি ভালো হবে।

বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারি মালিকানাধীন শেয়ার এবং কোম্পানির শেয়ার বাজারে আনা : ২২ মে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সঙ্গে অর্থ বিভাগের বৈঠকে বলা হয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এবং যেসব বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারি মালিকানা রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজারে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে মানসম্মত শেয়ার পুঁজিবাজারে আসবে। যা চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে। আলোচনায় আরও বলা হয়, ভালো ও মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। ফলে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে পুঁজিবাজারের গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ওই বৈঠকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি মালিকানার ৫ শতাংশ শেয়ার এবং বিদেশি কোম্পানির ৫ শতাংশ শেয়ার অর্থাৎ উভয়ের মোট ১০ শতাংশ শেয়ার পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া সরকারের লাভজনক ও সম্ভাবনাময় দেশীয় কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। তালিকাভুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আইপিও/ডিরেক্টর লিস্টিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির দায়িত্ব (ইস্যু ব্যবস্থাপনা) আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লি. পালন করবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইসিবি ও বিএসইসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

দেশি ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত : বৈঠকে আলোচনা হয় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্যে প্রণোদনা হিসাবে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হারের ব্যবধান ১০ শতাংশ হবে। সেখানে বলা হয় বিষয়টি বিবেচনা করলে ভালো ও মৌলিকভাবে শক্তিশালী কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত হবে। এছাড়া, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের সুযোগ তৈরি হলে ব্যাংক খাতের ওপর চাপ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস পাবে। তবে এ বিষয়ে চলতি বাজেটে ইতোমধ্যে এটি কার্যকর করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে করপোরেট করের ব্যবধান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।

বিদেশি বিশেষজ্ঞ দিয়ে বাজার সংস্কার : স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি রুখতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ৩ মাসের মধ্যে বাজার সংস্কারের নির্দেশনা প্রসঙ্গে ওই বৈঠকে আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া পুঁজিবাজার সংস্কার কমিশনের দাখিলকৃত সুপারিশের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্যগুলো দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।

বাজার অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা : বৈঠকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, পুঁজিবাজারের অনিয়মগুলো উদ্ঘাটনের জন্য টাস্কফোর্স কাজ করছে। প্রাপ্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ চলমান। ওই বৈঠকে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের আলোকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয় বিএসইসিকে।

শেয়ার বা বন্ড ছেড়ে ঋণের বিকল্প অর্থ সংগ্রহে পলিসি প্রণয়ন : আলোচনায় উঠে আসে ঋণনির্ভরতার বিকল্প হিসাবে পুঁজিবাজারকে গড়ে তোলা। বৈঠকে বলা হয়, দেশের বড় কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঋণের পরিবর্তে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি সংগ্রহে ব্যাংক ঋণের বিকল্প তৈরি করতে হবে। এতে ব্যাংক খাতের চাপ ও ঝুঁকি হ্রাস পাবে। সেখানে শেয়ার বা বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের বেলায় প্রয়োজনীয় পলিসি প্রণয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আইসিবিকে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রদান : সূত্র জানায়, বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে দেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ভূমিকা নিয়ে। এ সময় আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের পুঁজিবাজারকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে আইসিবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু সাম্প্র্রতিক সময়ে আর্থিক সংকটের কারণে আইসিবি পুঁজিবাজারে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। নিজস্ব তহবিল না থাকার কারণে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ সুদে ফান্ড সংগ্রহ করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে তাদের প্রদেয় সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে দরপতনের কারণে আইসিবির বিনিয়োগের বাজার মূল্য অনেক কমে গেছে। ফলে তারা পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না। এজন্য তিনি আইসিবিকে সরকারের পক্ষে স্বল্প সুদে ঋণ, পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিশেষ তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেন।

সভায় আলোচনা শেষে আইসিবির তারল্য সংকট নিরসন এবং পুঁজিবাজারকে গতিশীল করার লক্ষ্যে আইসিবিকে অর্থ বিভাগের সভরিন গ্যারান্টির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংক রেটে ন্যূনতম ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিএসইসিকে নির্দেশ দেয়।

১০ হাজার কোটি টাকার ক্যাপিটাল মার্কেট সাপোর্ট ফান্ড গঠন : বাজার পরিস্থিতি উন্নয়ন করতে ওই বৈঠকে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, পুঁজিবাজারের গতি আনতে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং বাজারে নগদ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের উদ্যোগে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি ‘ক্যাপিটেল মার্কেট সাপোর্ট ফান্ড’ গঠন করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি ফান্ড গঠনের ফলে বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবে। ওই বৈঠকে এ ফান্ড গঠনের ব্যাপারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বিএসইসি ও আইসিবিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।