Image description
চট্টগ্রামে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। শহীদ ওয়াসিম, শান্ত ও ফারুকের পরিবারে হাহাকার ।

২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরু থেকে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। সংস্কারের দাবিতে সরব হয়ে ওঠেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শিক্ষার্থীরা। পরে আন্দোলনকারীদের দুর্গে পরিণত হয় নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকা। ওই বছরের ১৫ জুলাই ষোলশহর এলাকায় ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন চবির পাঁচ শিক্ষার্থী। তবে আন্দোলনকারীরা সামনের দিকে এগিয়ে গেলে পিছু হটে ছাত্রলীগ। পরদিন ১৬ জুলাই একই স্থানে একটি বড় সমাবেশের ডাক দেন আন্দোলনকারীরা। আর সেই সমাবেশ প্রতিহত করার জন্য রণমূর্তি ধারণ করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। তাদের হামলায় প্রাণ হারান ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, শিবিরকর্মী ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও ফার্নিচার দোকানকর্মী মো. ফারুক। এই তিন প্রাণের বিনিময়ে সেদিন থেকে চট্টগ্রামে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। পরে সেটি আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।

ফেসবুকে ঘোষণা পেয়ে ১৬ জুলাই বিকাল সাড়ে ৩টায় নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে জমায়েত হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। তবে দুপুরের আগেই ছাত্রলীগের একাংশ নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে গিয়ে অবস্থান নেয়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর চারদিক থেকে হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। আন্দোলনে অংশ নেওয়া চবি শিক্ষার্থী মো. রোকনুজ্জামান বলেন, ‘১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলায় ৫ শিক্ষার্থী আহত হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ফেঁটে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ জুলাই ষোলশহর রেলস্টেশনে বিক্ষোভ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে শতাধিক কর্মী আন্দোলনকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি ও উসকানি দেওয়ার পর শিক্ষার্থীরা স্থান পরিবর্তন করে মুরাদপুর মোড়ে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা সেখানে হামলা শুরু করে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে চলে সংঘর্ষ। রক্তাক্ত অবস্থায় আন্দোলনকারীদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ভিড় লেগে যায় রক্তাক্ত মানুষের। সাইরেন বাজিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয় আহতদের। কাউকে নেওয়া রিকশায়, আবার কাউকে নেওয়া হয় অটোরিকশা কিংবা ভ্যানে করে। কারও পায়ে গুলি, কারও মাথা কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে। কাউকে কোপানো হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে। সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হতাহত মানুষদের উদ্ধারে স্থানীয়দের পাশাপাশি কাজ করছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। অধিকাংশ আহতকে প্রথমে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে।

জুলাই গণ-অভুত্থ্যানে চট্টগ্রামে নিহত ওয়াসিম আকরামের পরিবার এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বাবা শফিউল আলম ছেলের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যে সৌদি আরব থেকে দেশে চলে আসেন। এরপর আর বিদেশ যাননি। মা জ্যোৎস্না বেগম হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি। এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না ওয়াসিম নেই। দিনের বেশির ভাগ সময় ছেলের কবরের পাশে কাটান বাবা শফিউল আলম। ওয়াসিমের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান দুজনই। বুধবার ওয়াসিমের স্মরণে ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়েছে সভা। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের পক্ষ থেকে এই স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। সেখানে ওয়াসিমের মা-বাবা উপস্থিত ছিলেন।

নগরীর মুরাদপুরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন ওমর গণি এমইএস কলেজের বিবিএ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত। বরিশালের বাবুগঞ্জের উপজেলার ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের ছেলে শান্তকে হারিয়ে এখনো দিশেহারা তার পরিবার। স্কুল শিক্ষিকা মা কোহিনূর বেগমের কান্না এখনো থামছে না। স্কুলপড়ুয়া ছোট বোনও খুঁজে ফিরে তার ভাইকে। নগরীর লালখান বাজারে তাদের বাসা। জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূতিতে শান্তর পরিবারকে শান্ত্বনা দিতে পারছে না কেউ।

শান্তর মা কোহিনূর বেগম বলেন, ‘আমার বুকের ধনটাকে ছেড়ে আমাকে একটা বছর কাটাতে হচ্ছে, সারাজীবন কাটাতে হবে, এ দুঃখ আমি কীভাবে সইব!’ মৃত্যুর দুদিন আগে বাবা জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা হয়েছিল শান্তর। ছেলের সেই স্মৃতি রোমন্থন করে জাকির হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রামে গোলযোগ হচ্ছে সেটা শান্ত আমাকে বলেছিল। কিন্তু সেই গোলযোগের ১৬ তারিখ যে আমার ছেলে মারা যাবে তা কল্পনাও করিনি।’

১৬ জুলাই দুপুরে দোকান থেকে বের হয়ে ভাত খেতে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফার্নিচার দোকান কর্মচারী মো. ফারুক। তার স্ত্রী সীমা আক্তার এখনো স্বামীর কথা ভেবে চোখের জলে বুক ভাসান। হত্যার বর্ষপূর্তিতে স্বামী হারানোর শোকে বিহব্বল হয়ে পড়েন তিনি। যুগান্তরকে বলেন, ‘এই মৃত্যু আমি এখনো মেনে পারছি না। আমাকে সেদিন সকালে বলেছিলেন ফিরতে-ফিরতে রাত ১০টা হবে। প্রতিদিনই রাত ১০টা আসে। কিন্তু সে তো ফিরে আসে না। আমার দুই ছেলেমেয়ে এখনো তাদের বাবাকে খুঁজে ফিরে। বুধবার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে আয়োজিত সভা ও দোয়া মাহফিলে এসেছিলেন সীমা আক্তারও।

পুনর্বাসন করা হবে শহীদ পরিবারগুলোকে, দেশের ৮৬৪ স্থানে হবে শহীদ স্মৃতি ফলক-উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম : চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ৮৬৪ স্থানে জুলাই শহীদ স্মৃতিফলক স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক। এছাড়া পুনর্বাসন করা হবে শহীদ পরিবারগুলোকে। বুধবার চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট মোড়ে স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘শহীদ পরিবারের জন্য এককালীন অনুদান দেওয়া হচ্ছে, তাদের ভাতাও দেওয়া হবে। পুনর্বাসনের মাধ্যমে শহীদ পরিবারগুলো যেন সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে, সেই উদ্যোগ মন্ত্রণালয় নিয়েছে। এদের জন্য একটা অধিদপ্তর গঠন করা হয়েছে। ওই অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের বিষয়গুলো সবসময় দেখাশোনা করা হচ্ছে। ফারুক-ই-আজম আরও বলেন, জুলাই শহীদদের স্মরণে তারা যেখানে শহীদ হয়েছেন, সে স্থানে এসব ফলক বসানো হবে। একইসঙ্গে তাদের হত্যার বিচার দ্রুত করা হবে। এ জন্য সরকার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। ক্যাঙ্গারু কোর্ট নয়; সময় নিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে এই বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামে ১৫ জন শহীদ হয়েছেন।

এর মধ্যে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন মুরাদপুরে প্রাণ হারিয়েছেন ওয়াসিম, শান্ত, ফারুক, তানভীর, সাইমনসহ আটজন। তাদেরই স্মরণে বুধবার বহদ্দারহাট মোড়ে স্ট্রিট মোমোরি স্টাম্প নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম।

এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন-চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. জিয়াউদ্দীন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার শাখার উপপরিচালক মো. নোমান হোসেন।

‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’ নির্মাণ কাজের উদ্বোধনের পর উপদেষ্টা নগরীর পাঁচলাইশে জুলাই শহীদদের স্মরণে নির্মাণাধীন ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ পরিদর্শন করেন। এ সময় শহীদ পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।