
একটি সময় ছিল, যখন বাজারে ডলারের জন্য হাহাকার চলতো। বৈদেশিক লেনদেন সামলাতে গিয়ে ব্যাংকগুলো ছুটতো এক্সচেঞ্জ হাউজের পেছনে। এখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। ডলার সংকটের কঠিন সময় পার করে বাংলাদেশ এখন এক ধরনের মুদ্রা স্বস্তির মধ্যে প্রবেশ করেছে। যেখানে টাকার মান বাড়ছে, রিজার্ভ বাড়ছে, আর বৈদেশিক বাণিজ্যে শৃঙ্খলা ফিরছে। ব্যাংকগুলোর কাছে এখন পর্যাপ্ত ডলার রয়েছে। শুধু তাই নয়, মার্কিন ডলার এখন মার খাচ্ছে টাকার কাছে। যদিও অর্থনীতির ভাষায় বলতে হচ্ছে—ঘুরে দাঁড়াচ্ছে টাকার মান। ডলারের বিপরীতে চার কার্যদিবসে টাকার মান বেড়েছে প্রায় ২ টাকা ৯০ পয়সা। একসময় যেখানে ডলারের আন্তব্যাংক বিনিময় হার ছিল ১২২ টাকার ওপরে, সেখানে সোমবার (১৪ জুলাই) তা দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকা ১০ পয়সা। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে ‘অবমূল্যায়নের যুগ’ থেকে ‘স্থিতিশীল বিনিময় হারে’ প্রবেশের সম্ভাবনাই এখন দৃশ্যমান।
আরও অবাক করা বিষয় হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিহাস গড়ে নিলামের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনেছে—তাও অতিরিক্ত দামে। কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাই বাস্তব হলো চলতি জুলাই মাসে।
ড. আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বকেয়া আমদানি বিল পরিশোধে গুরুত্ব দেন। তবে তিনি রিজার্ভ থেকে ডলার না দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাজার থেকেই ডলার সংগ্রহের নির্দেশ দেন তিনি। ফলে এসব ব্যাংক বিপুল পরিমাণে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে থাকে। এমনও মাস গেছে, যখন তারা প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ডলার কিনেছে। সেই ডলারের মাধ্যমেই বকেয়া বিল পরিশোধ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে তাদের আর অতিরিক্ত ডলারের প্রয়োজন নেই।
টানা দরপতনে বদল গেছে চিত্র
গত এক সপ্তাহ ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। সোমবার (১৪ জুলাই) আন্তব্যাংক ডলার বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকা ১০ পয়সায়। এর এক সপ্তাহ আগেও এই হার ছিল ১২২.৮৫ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৫ কার্যদিবসে ডলারের দাম কমেছে প্রায় ২ টাকা ৭৫ পয়সা। এর মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক ১৭১ মিলিয়ন ডলার কিনেছে ১২১.৫০ টাকায়— যা বাজার দরের চেয়েও বেশি।
ডলারের দাম কমছে কেন?
১. রেমিট্যান্স ও রফতানি প্রবাহ বেড়েছে: বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮১ শতাংশ বা ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বেশি। এই প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করছে।
একই সময়ে রফতানি খাতেও ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত মিলছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় বাজারে তৈরি পোশাক ও চামড়াজাত পণ্যের অর্ডার আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এতে রফতানি আয়ও ধীরে ধীরে চাঙা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বৃদ্ধি ডলারের বিপরীতে টাকার দর বৃদ্ধির প্রধান কারণ। পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কিছুটা হ্রাস পাওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বকেয়া বিল পরিশোধ সম্পন্ন হওয়া এবং হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রণে আসাও বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এসব ইতিবাচক প্রবণতা রিজার্ভে স্বস্তি ফিরিয়েছে এবং ডলার সংকট মোকাবিলায় শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে।
২. বিনিয়োগ স্থবির, চাহিদা কম: বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির থাকায় মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও বিলাসী পণ্যের আমদানি কমে গেছে।
মুদ্রাবাজার বিশ্লেষক ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ কার্যক্রম প্রায় স্থবির। ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও অন্যান্য আমদানির পরিমাণও তুলনামূলক কম। এছাড়া, সরকারি আমদানির বিল পরিশোধ হয়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ডলারের চাহিদা নেই বললেই চলে। বেসরকারি খাতেও এলসি খোলার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
৩. হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং কমেছে: রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাজারে আত্মবিশ্বাস ফিরেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এনবিআরের যৌথ অভিযানে হুন্ডি ও অবৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহে লাগাম টানা গেছে।
৪. ডলার সংকটের ভয় আর নেই: আগে যেসব ব্যাংক অতিরিক্ত দামে ডলার কিনে রাখতো, এখন তারা তা বিক্রি করতেও আগ্রহী নয়। কারণ, বাজারে মূল্য আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা।
আইএমএফের শর্তে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার
গত মে মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিজস্ব দরেই ডলার লেনদেন শুরু হয়, যা সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা কমায়। এতে বাজার নিজেই ভারসাম্য খুঁজে নিচ্ছে। তবে গত এক সপ্তাহের ধারাবাহিক দরপতন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আবার হস্তক্ষেপে বাধ্য করে।
নতুন নজির: বাংলাদেশ ব্যাংকের নিলামে ডলার কেনা
বাজারে ডলারের দাম পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিলামের মাধ্যমে ১৮টি ব্যাংক থেকে ১৭১ মিলিয়ন ডলার কিনেছে, সর্বনিম্ন ১২১.৫০ টাকা দরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “টাকার মান হঠাৎ বেশি বেড়ে গেলে রফতানি ও রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই আমরা হস্তক্ষেপ করেছি, যেন বাজারে ভারসাম্য থাকে।”
নিলামে অংশ নেওয়া এক ব্যাংক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক উচ্চ রেটে ডলার কিনে এক ধরনের সিগন্যাল দিয়েছে—এই রেটের নিচে আর নামা ঠিক হবে না।”
যদিও নতুন উদার বিনিময় হার নীতির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি রেট নির্ধারণ না করে বাজারকে ‘নিয়ন্ত্রণমূলক স্বাধীনতা’ দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “যখন দেখা গেলো ডলারের দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে পড়ে যাচ্ছে, তখন মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ অতিরিক্ত দরপতন রফতনিকারক ও রেমিট্যান্স প্রেরকদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।”
নিলামে অংশ নেওয়া একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “বাজারে ডলারের আতঙ্ক ছিল। সবাই ধরেই নিচ্ছিল দর আরও নামবে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে ইঙ্গিত দিয়েছে—এর নিচে দাম নামবে না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যার ফলে কম রেটে ডলার বিক্রি করতে চাওয়া ব্যাংকগুলোও উৎসাহ পেয়েছে।
নিলামে অংশ নেওয়া একটি ব্যাংকের ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “ডলারের দাম দ্রুত কমায় ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ডলার হাতে রাখতে চাইছে না। কারণ, বেশি দামে ডলার কিনে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে, যা লোকসানে পরিণত হচ্ছে।” একটি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের কান্ট্রি হেড বলেন, “আগে ব্যাংকগুলো আমাদের কাছ থেকে ডলার চেয়ে ফোন করতো, এখন উল্টো আমরা ডলার অফার করলেও তারা নিচ্ছে না। এতে প্রমাণিত হয় বাজারে ডলারের প্রাপ্যতা বাড়লেও চাহিদা স্থবির।”
রিজার্ভে উল্লম্ফন: ২৪.৫৪ বিলিয়নে উন্নীত
প্রবাসী আয় ও আইএমএফের কিস্তি ছাড়, সঙ্গে আমদানির ব্যয় সংকোচনের ফলে রিজার্ভে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৪.৫৪ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বেশি। অপরদিকে, আমদানি খাতে চাপ কম থাকায় নতুন করে ডলারের চাহিদা বাড়ছে না।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “ডলার নিয়ে এখন ব্যাংকগুলো আগ্রহ হারাচ্ছে। তারা ধরে রাখতে চাইছে না, বরং বিক্রি করতে চাইছে। ফলে বাজারে চাপ কমেছে, আর এতে টাকার মান বেড়েছে।”
ঢাকা ব্যাংকের এমডি শেখ মো. মারুফ বলেন, “ভারত বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশ নিয়মিত তাদের মুদ্রা অবমূল্যায়ন করে। আমরা এখন টাকার মান বাড়াতে পারছি, এটা সাময়িক সাফল্য। তবে দীর্ঘমেয়াদে টাকার মান আরও শক্তিশালী করতে হলে কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কার দরকার।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বর্তমানে যে স্বস্তির পরিবেশ বিরাজ করছে, তা নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক। তবে এটি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নির্ভর করবে রেমিট্যান্স ও রফতানির ধারাবাহিকতা এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতিনির্ধারণের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকও কৌশলী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।