
মাহমুদুল হাসান মহিন আগে থেকেই চাঁদাবাজ হিসেবে মিটফোর্ড এলাকায় পরিচিত। ওই এলাকায় তার নেতৃত্বে চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এ ছাড়াও আগে থেকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রবাজি, হামলা, মারামারিসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী সোহাগকে পিটিয়ে পাথর দিয়ে থেঁতলে নির্মমভাবে হত্যার নেতৃত্ব ও পরিকল্পনাকারী ছিল এই মহিন। ঘটনার দিন সড়কে সোহাগের লাশ রেখে নিজেদের লোকজনকে নিয়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মিছিল করছিল মহিন। সেখানে সে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে স্লোগানও দিচ্ছিল। সেখান থেকেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে এমন একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
শত শত মানুষের সামনে সোহাগকে যখন বর্বরভাবে পিটিয়ে পাথর দিয়ে থেঁতলে নিহত করে লাশের উপর খুনিরা লাফালাফি করছিল, তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা না থাকলেও তারা বাকরুদ্ধ-স্তম্ভিত ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ পৈশাচিকভাবে হত্যা করে মূল অভিযুক্ত মহিন ও অন্য ঘাতকরা সোহাগের লাশের পাশেই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিলো। যার নেতৃত্ব ছিল মহিন। সোহাগের নিথর দেহের পাশেই দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠেছিল মহিন ‘চাঁদাবাজের ঠাঁই নাই!’ ‘আওয়ামী দোসরদের বিচার চাই!’ এ সময় আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এক নাটকীয় মিছিল, যেন সেটিকে মনে হয় জনরোষের বিস্ফোরণ। ততক্ষণে কোতোয়ালি থানা পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে মহিনকে শনাক্ত করা হয়। পরে মহিনকে আটক করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। আটকের পর মহিন ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে নানাভাবে হুমকি দেয়। এর সঙ্গে তাল মেলান সেখানে উপস্থিত আরও কিছু লোক। স্থানীয়ভাবে বড় বাধার সম্মুখিন হতে হয় পুলিশকে। বিভিন্নভাবে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তার সাহসিকতায় আটক করে থানায় আনা হয় মহিনকে। তার তথ্যমতেই আরেক আসামি তারেক রহমান রবিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, সোহাগ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে হত্যা করে ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। না হলে প্রকাশ্য নির্মমভাবে একজনকে হত্যা করে লাশ পাশে রেখেই কীভাবে খুনিরা মিছিল- স্লোগান দিতে পারে। গোয়েন্দাসূত্র বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ রয়েছে। এর পেছনে চাঁদাবাজি, দোকান দখল, ব্যবসায়িক লভ্যাংশের ভাগ নিছক গল্প মাত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুনিরা চেয়েছিল এই হত্যাকাণ্ড যেন মবকাণ্ড বা উত্তেজিত জনতার প্রতিক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। এছাড়া প্রকাশ্যে রাস্তায় হত্যা করলে এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারও সহজ হবে বলে মনে করেছিলেন এই হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা মাহমুদুল হাসান মহিন এবং অপু দাস। তবে খুনের বিভীষিকাময় ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ভেস্তে যায় খুনিদের গল্প সাজানোর পরিকল্পনা। স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এটি ছিল সুপরিকল্পিত এবং ক্ষমতার দাপট দেখানো একটি হত্যাকাণ্ড।
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, ঘটনার পর মহিন ও অন্যরা সেখানে নিজেরাই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মিছিল- স্লোগান দিচ্ছিলো। আমরা আগে শনাক্ত করে পরে তাকে আটক করি। মিছিলটি অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠনের ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্য কোনো সংগঠনের মিছিল নয়, তারা নিজেরাই মিছিল করছিল। এ সময় তিনি বলেন, হত্যার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আসামিদের সবাইকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
আসামি রাজীব-সজীব রিমান্ডে: সোহাগ হত্যার ঘটনার মামলায় রাজীব বেপারী ও সজীব বেপারী নামে দুই আসামির ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আসামিরা সম্পর্কে সহোদর। গতকাল বিকালে শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম মিয়া রিমান্ডের এ আদেশ দেন। এ সময় তাদের আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাদের সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। এ সময় বিচারক আসামিদের কাছে জানতে চান তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আছে কিনা। তখন আসামি রাজীব বলেন, আমাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী নেই। এই যে আমার বড় ভাই (সজীব) এখানে আছে। আমি কিছুই করিনি। আমি নির্দোষ। তবে এ সময় আসামি সজীব কিছু বলেননি। শুনানি শেষে আদালত তাদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এছাড়া অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার থাকা আরেক আসামি তারেক রহমান রবিনকে সোহাগ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম মিজবাহ উর রহমানের আদালত তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন। এর আগে গত রোববার ভোরে নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌরসভার চায়না মোড় এলাকা থেকে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় রাজীব ও সজীবকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর আগে সোহাগ হত্যা মামলায় গত ১০ই জুলাই মাহমুদুল হাসান মহিনকে পাঁচদিনের রিমান্ড এবং গত ১২ই জুলাই টিটন গাজীর পাঁচদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। এ ঘটনায় করা অস্ত্র আইনের মামলায় গত ১০ই জুলাই তারেক রহমান রবিনের দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে ১২ই জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এছাড়া গত ১৩ই জুলাই এ মামলায় আসামি মো. আলমগীর ও মনির ওরফে লম্বা মনিরের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আসামিদের পক্ষে লড়বেন না বিএনপি’র আইনজীবীরা: সোহাগকে পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডে আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবে না বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বার ইউনিটের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। সোমবার ঢাকা আইনজীবী সমিতির দ্বিতীয়তলায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান- ফোরামের আহ্বায়ক মো. খোরশেদ আলম। সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের সদস্য সচিব নিহার হোসেন ফারুকের সঞ্চালনায় ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ইকবাল হোসেন, আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল খালেক মিলন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে খোরশেদ আলম বলেন, সোহাগ হত্যার এই ঘৃণ্য নৃশংসতার তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে সকল আসামির দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি জাহীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ঢাকা বার ইউনিটের কোনো সদস্য সোহাগ হত্যা মামলায় আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন না সিদ্ধান্ত নিয়েছে।