
বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে থাকে, সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও দেখা দেয় বন্যা। আর বন্যা মানেই বিভিন্ন কীট-পতঙ্গের পাশাপাশি সাপের উপদ্রব। এই চিত্র কেবল গ্রামেরই নয়, শহরেও বর্ষাকালে অনেক বাসায় সাপ উঠে আসে।
এছাড়া যারা বর্ষার সময় বনে বা পাহাড়ে ঘুরতে যান তাদেরও প্রায় সময় সাপের কবলে পড়তে হয়। বিগত বছরগুলোতে দেশজুড়ে সাপ কামড়ানোর ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। তবে সব সাপের বিষ থাকেনা, আবার সব বিষধর সাপের কামড়ও তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণঘাতী নয়। কিন্তু সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে অনেকেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন না। এমন অনেক কাজ তারা করে বসেন, যার কারণে জীবন আরও হুমকির মুখে পড়ে যায়। তাই চলুন, সাপে কামড়ালে কী করবেন এবং কোন কাজগুলো অবশ্যই করবেন না, তা জেনে নেওয়া যাক-
সাপে কাটলে যা করবেন-
সাপে কাটা ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সেই এলাকার পরিচিত সাপের বিষের জন্য ওষুধ থাকে। তবে হাসপাতালে যাওয়ার পথে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কিছু কাজ করা যেতে পারে-
১. আক্রান্ত ব্যক্তির ভয় কমানোর চেষ্টা
সাপে কামড়ানো ব্যক্তি অতিরিক্ত আতঙ্কিত হয়ে থাকেন, এই মানসিক অবস্থায় কোনো ভুল সিদ্ধান্ত প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির ভয় দূর করার জন্য তাকে সাহস দিতে হবে। নির্বিষ সাপে কামড়ালে মৃত্যু হয় না, তাই যে সাপে কামড়েছে তার বর্ণনা শুনে নিন। বাংলাদেশের বিষধর সাপের সংখ্যা খুবই কম। তাছাড়া এগুলো অধিকাংশ সময় শিকারের শরীরে পর্যাপ্ত বিষ ঢুকিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। তাই আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের কাছে পোঁছানোকে বেশি গুরুত্ব দিন।
২. নড়াচড়া নয়
ব্যক্তির আক্রান্ত অঙ্গকে অবশ্যই স্থির করে রাখতে হবে। খুব বেশি নড়াচড়া করা যাবে না। হাঁটাচলা বা ঝাঁকুনি থেকে বাঁচিয়ে স্থির ভাবে আধশোয়া অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
৩. ব্যান্ডেজ করুন
ক্ষতস্থানে হালকা চাপ দিয়ে ব্যান্ডেজ বেধে দিতে হবে। এই প্রাথমিক চিকিৎসাটির নাম প্রেসার ইমোবিলাইজেশন। হাসপাতাল দূরে হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এভাবে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়ে রওনা দেওয়া ভালো। ব্যান্ডেজের বদলে গামছা বা ওড়না জাতীয় কাপড়ও ব্যবহার করতে পারেন।
৪. নিশ্বাস-প্রশ্বাসে নজর রাখুন
রোগী শ্বাস নিচ্ছে কিনা খেয়াল করুন। না নিলে তাৎক্ষণিক তার মুখে শ্বাস দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
৫. জীবাণুমুক্ত ক্ষতস্থানে রক্তচলাচলের ব্যবস্থা
সাপ শরীরের যে স্থানে কামড়িয়েছে, যে জায়গাটি জীবাণুমুক্ত করার জন্য সাবান দিয়ে ধুয়ে ভেজা কাপড় দিয়ে হাল্কা ভাবে মুছে নিতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির পরনে কোনো অলঙ্কার, ঘড়ি, তাগা বা তাবিজ থাকলে তা খুলে ফেলতে হবে। এগুলো রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
সাপে কামড়ালে যে ভুলগুলো করা উচিত নয়
১. সময় নষ্ট করবেন না
২০২৪ সালের জুন মাসে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এখনো সাপের কামড়ে আক্রান্ত ৬১ শতাংশ মানুষ ওঝার কাছে যান; যাদের বেশির ভাগই ভুল চিকিৎসা দেন।
তাই সাপে কাটা ব্যক্তিকে ওঝার কাছে নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। সাপটি যদি বিষধর হয়ে থাকে, তাহলে এই সময় নষ্ট ওই ব্যক্তির মৃৃত্যুর কারণ হতে পারে।
২. ওষুধ মনে করে কোনো কিছু লাগাবেন না
আক্রান্ত অঙ্গে কোনও ধরণের ভেষজ ওষুধ, উদ্ভিদের বীজ, লালা, গোবর, কাদা, বা পাথর লাগাবেন না। এতে কোনো উপকার তো হবেই না, বরং অপকার হতে পারে।
৩. মুখ দিয়ে টেনে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না
নাগ-নাগিনীর সিনেমা দেখে অনেকেই মনে করেন যে, আক্রান্ত স্থানে মুখ দিয়ে টেনে বিষ বের করলে রোগী ভালো হয়ে যায়। কিন্তু সাপের বিষ আসলে লসিকা ও রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়, যা এই পদ্ধতিতে বের করা অসম্ভব। এছাড়া আক্রান্ত স্থানে যিনি মুখ দিচ্ছেন, তার জন্যও বিষয়টি ক্ষতিকর।
৪. শক্ত বাঁধন দিয়ে বাধবেন না
পুরোনো একটি চর্চা হলো, সাপে কামড়ানোর স্থানে অনেকে শক্ত বাঁধন বা গিট দিয়ে বেঁধে ফেলা। যেহেতু বিষ রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে কামড়ানোর স্থান থেকে কিছুটা ওপরের দিকে শক্ত করে বাঁধা হয়। মূলত এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এতে বরং উল্টো রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে সঠিক রক্ত প্রবাহের অভাবে টিস্যুতে পচন বা নেক্রোসিস-এর উপক্রম হতে পারে।
৫. আক্রান্ত স্থান কেটে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না
সাপ কামড়ানোর স্থানে ছুরি বা ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেওয়া যাবে না। বিষ বের করার জন্য অনেকে এমনটি করে থাকেন। কিন্তু এর জন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সরণাপন্ন হওয়া উচিত। এভাবে এলোপাথাড়ি কেটে বিষ বের করা সম্ভব না।
৬. নিজে নিজে ওষুধ খাওয়াবেন না
সাপে কামড়ানোর ব্যথা দূর করতে মোটেই অ্যাস্পিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়াবেন না। সেই সঙ্গে কোনও ধরণের রাসায়নিক পদার্থ লাগানো বা তা দিয়ে আক্রান্ত স্থানে সেঁক দেওয়া ঠিক নয়।
৭. বমি করানোর চেষ্ট করবেন না
অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তির খাবার বা ঢোক গিলতে কিংবা কথা বলতে সমস্যা হয়। পাশাপাশি নাঁকি কণ্ঠ, বমি, বা অতিরিক্ত লালা নিঃসরণের মত ঘটনা ঘটতে পারে। এর প্রতিকার হিসেবে অনেকে তাকে কিছু খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করেন। এই কাজটি করা বিপদজ্জনক ও অনুচিত।
কাউকে সাপ কামড়ালে তাকে তাৎক্ষণিক প্রথমিক চিকিৎসা দেওয়ার বেশ কিছু কার্যকর উপায় আছে। তাই সাপের বিষ বের করার বা ব্যথা কমানোর যে ভুল ধারণা ও কুসংস্কারগুলো সমাজে প্রচলিত আছে, এগুলোকে পাত্তা দেবেন না। আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। যথাযথ চিকিৎসা পেলে তার বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
সূত্র: ইউএনবি