Image description
 

এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ভয়াবহ ফল বিপর্যয় হয়েছে, যা বিগত ১৫ বছরে সর্বনিম্ন। সব বোর্ডেই গণিতে খারাপ করার প্রভাব পড়েছে সার্বিক পাশের হারে। ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজিতেও খারাপ করেছে, তবে গণিতের মতো নয়। দেশের ১১ শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ২৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গণিতে ফেল করেছে। 

 

অপরদিকে ইংরেজিতে ফেল করেছে ১৩ শতাংশ। দুই বিষয়েই ফেলের হার গত কয়েক বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া মানবিক বিভাগে ৪৬ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এসবের প্রভাব পড়েছে এবার সার্বিক ফলে। ফলাফল পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। 

দীর্ঘদিন ধরে চলা পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া বা পাশের হার বাড়ানো থেকে বেরিয়ে এসছে অন্তর্বর্তী সরকার। শিক্ষার্থীদের অপ্রাসঙ্গিক ও ভুল উত্তরে নম্বর না দেওয়া এবং যথাযথ মূল্যায়নের নির্দেশনা ছিল বোর্ড থেকে। এতে ফলাফলে প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

বৃহস্পতিবার দুপুরে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এসএসসি, মাদ্রাসা বোর্ডের দাখিল এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি ও দাখিলসহ (ভোকেশনাল) ১১ বোর্ডের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে সর্বমোট পাশের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ হার গত বছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। ১৫ বছরের মধ্যেও এবারের পাশের হার সর্বনিম্ন শুধু পাশই নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। এবার সর্বমোট ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। সেই হিসাবে জিপিএ-৫ কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭টি। তবে এবারও ছাত্রীরা বেশ ভালো করেছে। ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের পাশের হার প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। ছাত্রদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে ।

৯টি সাধারণ বোর্ডের মধ্যে ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ৬৭.৫১ শতাংশ, জিপিএ-৫ ৩৭০৬৮ জন। রাজশাহীতে পাশের হার ৭৭.৬৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ ২২৩২৭ জন। কুমিল্লায় পাশের হার ৬৩.৬০ শতাংশ, জিপিএ-৫ ৯৯০২ জন। যশোরে পাশের হার ৭৩.৬৯ শতাংশ, জিপিএ-৫ ১৫৪১০ জন। চট্টগ্রামে পাশের হার ৭২.০৭ শতাংশ, জিপিএ-৫ ১১৮৪৩ জন। বরিশালে পাশের হার ৫৬.৩৮ শতাংশ, জিপিএ-৫ ৩১১৪ জন। সিলেটে পাশের হার ৬৮.৫৭ শতাংশ, জিপিএ-৫ ৩৬১৪ জন। দিনাজপুরে পাশের হার ৬৭.০৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ ১৫০৬২ জন। ময়মনসিংহে পাশের হার ৫৮.২২ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৬৭৮ জন। অপরদিকে মাদ্রাসা বোর্ডে পাশের হার ৬৮ দশমিক ৯ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯ হাজার ৬৬ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাশের হার ৭৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৯৪৮ জন।

এদিকে পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার পেছনে পরীক্ষার হলে এবং খাতা মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’কে বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। শিক্ষার প্রকৃত মান যাচাই ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে বাস্তবসম্মত করতে এই কড়াকড়ি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় দশক ধরে খাতা মূল্যায়নে উদারনীতির কারণে দেশে পাশের হার এবং জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর থেকে খাতা মূল্যায়নে উদার হওয়ার চর্চা ব্যাপকতা পায়। পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়, খাতায় কিছু লেখা থাকলেই যেন নম্বর দেওয়া হয়। এতে পাশের হার ও জিপিএ-৫-এর হার কমে। শিক্ষার সার্বিক মান নিয়ে দেশবিদেশে প্রশ্ন ওঠে। 

এ বিষয়ে বুধবার শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়েছে। ১৬ বছরে যে সরকার ছিল, তাদের আমলে সরকারের সাফল্য দেখানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফল প্রকাশ করা হতো। এমনকি সে ফল প্রকাশ নিয়ে একধরনের ফটোসেশনের আয়োজন ছিল সরকারপ্রধানের। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার এটাকে বাহুল্য মনে করছে। এটা থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতার প্রকৃত মূল্যায়নে শিক্ষা বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। 

শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রেজাল্ট প্রকাশের কারণে অতীতে ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়ায় তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পরীক্ষায় পাশের হার বাড়ানোর পাশাপাশি জিপিএ-৫-এর সংখ্যাও বেশি পরিমাণে দেখানো হয়েছে। আমরা এবার জিপিএ-৫ নয়, প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন দেখতে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার রেজাল্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা তাদের সেই মেধার যথাযথ মূল্যায়ন দেখতে পাবে। আগামী দিনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

ফল বিশ্লেষণে পাশের হার কমে যাওয়ার পেছনে আরও দুটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এর একটি হচ্ছে, মানবিক বিভাগে পাশের হার মাত্র ৫৪ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের পাশের হার মাত্র ৬৬ শতাংশ। এ দুই বিভাগের ফল সার্বিক পাশের হারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এবার মানবিকে প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। আর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।

এবার পাশের হার কমে যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক খারাপ ফল। এবার সর্বমোট ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাশ করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ ছাত্রছাত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের সর্বনিম্ন পাশের হার বরিশাল বোর্ডে, যা মাত্র ৫৬ শতাংশ। এর পরে রয়েছে ময়মনসিংহ বোর্ড, যেখানে পাশের হার মাত্র ৫৮ শতাংশ। ফেল করা এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই গ্রামের এবং সুবিধাবঞ্চিত অভিভাবকের সন্তান।

বিগত বছরগুলোয় এসএসসি পরীক্ষার ফল কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হতো। প্রধানমন্ত্রী ফল প্রকাশের ঘোষণা দিতেন। এরপর শিক্ষার্থীরা ফল জানতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সচিবালয় অথবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষামন্ত্রী সব বোর্ড চেয়ারম্যানকে নিয়ে ফলাফলের সারসংক্ষেপ তুলে ধরতেন। তবে এবার সেই নিয়মে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। 

বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সম্মেলনকক্ষে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির। একই সময়ে স্ব স্ব শিক্ষা বোর্ড ফল প্রকাশ করে। শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় ও নিজ শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে ফল সংগ্রহ করেন। 

এ সময় বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, যে ফল প্রকাশিত হয়েছে সেটি প্রকৃত ও সত্য। শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের অতিরিক্ত নম্বর দেওয়ার জন্য কাউকে বলা হয়নি। সামগ্রিকভাবে এবারের ফলে প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে।’ 

তিনি বলেন, ‘আগে কী হয়েছে সেটি আমরা বলব না। আমাদের ওপর মহল থেকে কোনো ধরনের চাপ ছিল না। আমাদের বলা হয়েছে, রেজাল্ট যা হবে, সেটিই দিতে হবে। আমরাও পরীক্ষকদের এ অনুরোধ জানিয়েছি। তাদের যথার্থভাবে খাতা মূল্যায়ন করার জন্য বলা হয়েছে। কাজেই যা বাস্তব, যা সত্য সেই ফল বেরিয়ে এসেছে। আমরা কাউকে নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলি না, কমাতেও বলি না। সঠিক মূল্যায়ন করতে আমরা শিক্ষকদের বাধ্য করেছি।’

প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে বরিশাল বোর্ড। এ বোর্ডে পাশের হার মাত্র ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ফেল করেছে প্রায় ৪৪ জন। এছাড়া সবচেয়ে ভালো ফল করেছে রাজশাহী বোর্ড। যার পাশের হার ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এছাড়া ১১ বোর্ডে মেয়েদের পাশের হার ৭১ দশমিক ০৩ শতাংশ, ছেলে ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে মেয়ে ৭৩ হাজার ৬১৬ জন, ছেলে ৬৫ হাজার ৪১৬ জন। পাশের হার ও জিপিএ দুটোতেই মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। 

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশে শতভাগ পাশ করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৮৪টি। অন্যদিকে ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীই পাশ করেনি। মোট প্রতিষ্ঠান ছিল ৩০ হাজার ৮৮টি। এবার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, পরীক্ষার কেন্দ্র কমেছে। 

চলতি বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ১০ এপ্রিল। পরীক্ষা শেষ হয় ১৩ মে। এ পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছিলেন ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৯৭০ জন। তাদের মধ্যে ছাত্রী ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৯ জন এবং ছাত্র ৯ লাখ ৬১ হাজার ২৩১ জন। যদিও পরীক্ষার প্রথম দিনেই সারা দেশের ৩ হাজার ৭১৫টি কেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিলেন ২৮ হাজার ৯২৮ জন পরীক্ষার্থী। সবমিলিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেন প্রায় ১৯ লাখ শিক্ষার্থী। দুই মাসের মধ্যে এই ফল প্রকাশ করা হয়। 

সর্বশেষ ১৫ বছরের ফলাফল যেমন ছিল : ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাশের হার এক লাফে প্রায় ১৩ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। সে বছর গড় পাশের হার ছিল ৮০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ৮০ শতাংশের ওপর পাশের হার দেখা যায়। ২০১১ সালে পাশের হার দাঁড়ায় ৮২ দশমিক ১৬ শতাংশ, ২০১২ সালে ৮৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৮৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৭ সাল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ, ২০২০ সালে ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২০২১ সালে ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ (করোনার বছরে অটোপাশ), ২০২২ সালে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে পাশের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

এসএসসির ফল চ্যালেঞ্জ আজ থেকে: চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় কেউ কাক্সিক্ষত ফল না পেলে তিনি পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন বা খাতা চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। এ কার্যক্রম শুরু হবে আজ (শুক্রবার) থেকে, চলবে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিটি বিষয়ে আবেদনের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ টাকা। আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।