
চলতি বছর মধু আহরণ কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় পতন। এর সঙ্গে রয়েছে মৌয়ালদের নিরাপত্তাহীনতা, বনবিভাগের নিষেধাজ্ঞা ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। সব মিলিয়ে সুন্দরবনের এ বনজখাত পড়েছে অনিশ্চয়তায়।
২০২৫ সালের এপ্রিলে দেশের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) স্বীকৃতি পায় সুন্দরবনের মধু। তখন আশা করা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের জন্য এটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। কিন্তু মৌসুম শেষে ভিন্ন চিত্র সামনে এসেছে।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ হয়েছে ২০৭ মেট্রিক টন, যেখানে ২০২৪ সালে ছিল ৩৪৫ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এক বছরে মধু উৎপাদন কমেছে ১৩৮ মেট্রিক টন, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৪০ শতাংশ।
সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে মধু আহরণ হয়। এ বছর মৌসুমি বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় গাছে ফুল কম ফুটেছে, ফলে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করতে পারেনি। জুন-জুলাইয়ে কিছু এলাকায় ফুল ফুটলেও বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞার কারণে মৌয়ালরা বনে প্রবেশ করতে পারেননি।
এ বছর শুধু মধু নয়, মধু আহরণে অংশগ্রহণকারী মৌয়ালের সংখ্যাও কমেছে। গত বছর পাঁচ হাজারের বেশি মৌয়াল অংশ নিলেও এ বছর সেই সংখ্যা নেমে এসেছে চার হাজারের নিচে। মৌয়ালদের অনেকে জানিয়েছেন, বনে নিরাপত্তার অভাব এবং জলদস্যুদের কারণে তারা আগ্রহ হারাচ্ছেন।
মৌয়াল শাহিন আলী বলেন, ‘বৃষ্টিও হয়নি, ফুলও কম। তার ওপর নিষেধাজ্ঞা, নিরাপত্তাহীনতা। এভাবে তো আর বনে যাওয়া যায় না। এবার গিয়েও লাভ হয়নি।’
আরও এক মৌয়াল বলেন, ‘বনে জলদস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। ধরা পড়লে ১০-২০ হাজার টাকা দিতে হয়, তাতে আর লাভ থাকে না।’
২০২৫ সালে সংগৃহীত মধুর মধ্যে পশ্চিম সুন্দরবন থেকে এসেছে ১৪২.৮ মেট্রিক টন এবং পূর্ব সুন্দরবন থেকে ৬৪.৭ মেট্রিক টন, অর্থাৎ অধিকাংশ মধুই আহরণ হয়েছে পশ্চিমাঞ্চল থেকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নিরাপত্তা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনের বনায়ন, ফুলের সংখ্যা ও মৌমাছির আচরণেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক নাজমুস সাদাত বলেন, ‘বনের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে হলে নিরাপত্তার পাশাপাশি গবেষণা ও পরিবেশগত বিশ্লেষণ জরুরি।’
সুন্দরবন বন বিভাগের সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘আমরা মৌয়ালদের সঙ্গে আলোচনা করছি। তাদের নিরাপত্তা ও উৎসাহ দিতে কিছু নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে। একইসঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবর্তনকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’
সুন্দরবনের মধু বাংলাদেশের ঐতিহ্য, জীবিকা ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জিআই স্বীকৃতির পর এর ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়লেও, টিকিয়ে রাখতে হলে পরিবেশ ও মৌসুমি বৈচিত্র্য মাথায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া জরুরি। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সম্ভাবনাময় এই খাতটি ভবিষ্যতে বড় সংকটে পড়তে পারে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।