Image description

বহুল আলোচিত ২০০৯-১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির কথা নিশ্চয় এখনো সবার মনে আছে। দেশ-কাঁপানো ওই শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় হাজারো মানুষ পথে বসেছিল, নিঃস্ব হয়েছিল। শেয়ারবাজারের সামনে মানুষের আর্তনাদ, আহাজারি আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসনের চিত্রকেই ফুটিয়ে তুলেছিল। শেয়ার মার্কেটের এই ভয়াবহ ঘটনার পর গঠিত হয়েছিল একটি তদন্ত কমিটি।

প্রয়াত ব্যাংকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় এই তদন্ত কমিটি। ওই কমিটি শেয়ার কেলেঙ্কারির আদ্যোপান্ত অনুসন্ধান করে এবং কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। মূল হোতাদের অন্যতম ছিলেন সালমান এফ রহমান ও লোটাস কামাল। অথচ এই রিপোর্ট যখন জমা দেওয়া হয়, তখন সালমান-লোটাস কামাল নানা রকম কূটকৌশল গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা ওই রিপোর্ট স্থগিত রাখতে সক্ষম হন; যা আর আলোর মুখ দেখেনি।

শেয়ারবাজারের অন্যতম মাফিয়া ছিলেন লোটাস কামাল। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল, তখন তিনি অর্থমন্ত্রী। ওই সময় অসুস্থতার মধ্যেও তিনি শেয়ার কেলেঙ্কারি চালিয়ে গেছেন সমানভাবে।

কারসাজির মাধ্যমে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন ২০ হাজার কোটি টাকা। এতে নিঃস্ব হয়েছে বহু মানুষ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লোটাস কামালের ব্যবসা আসলে কিছুই নেই। বেশির ভাগ ব্যাংকের হিসাব বা আয়কর বিবরণীতে তাঁর সব ব্যবসাই লোকসানি প্রতিষ্ঠান। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কিভাবে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়লেন? এই প্রশ্নের উত্তরে খুঁজতে গেলে দেখা যায়, মূলত শেয়ারবাজারে নয়ছয়ের মাধ্যমেই লোটাস কামাল হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এখনো শেয়ারবাজারে যে নানা রকম ঘটনা ঘটছে, সেসব ঘটনার পেছনেও লোটাস কামাল গ্যাংয়ের হাত রয়েছে। একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লোটাস কামাল এই শেয়ারবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। লোটাস কামালসহ কয়েকজন চিহ্নিত মাফিয়ার বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে শেয়ারবাজার কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না বলেও অনেকে মনে করে।

২০০৯-১০ সালে শেয়ার কারসাজির ঘটনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ছিলেন আলোচিত ব্যক্তি। ২০১০ সালে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে ভয়াবহতম ধসের পর ২০১১ সালে সরকার প্রয়াত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করেছিল। ওই কমিটির প্রতিবেদনে কামালের তৎকালীন মালিকানাধীন সিএমসি কামাল টেক্সটাইল নামের বন্ধ ও লোকসানি কম্পানির শেয়ারের দর কিভাবে ১৬ গুণ পর্যন্ত বেড়েছিল, তার বিস্তারিত উঠে এসেছে।

ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, লোকসানি হওয়া সত্ত্বেও কম্পানিটির শেয়ারদর যখন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছিল, তখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে কম্পানিটির কাছে রুটিনমাফিক ‘দর বৃদ্ধির কোনো কারণ আছে কি না—এমন চিঠি দেওয়া হয়। মুস্তফা কামাল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি থাকায় তাঁর কম্পানির বিষয়ে কোনো তদন্ত করা হয়নি।

তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯-১০ সালের যেসব ইস্যু ব্যবহার করে কম্পানিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁদের শেয়ারদর প্রভাবিত করেছিলেন, তার সবটাই ব্যবহার করেছিলেন কামাল। যেমন—ওই দুই বছরে কোনো কম্পানি স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে যাচ্ছে—এমন খবর ছড়ালেই সংশ্লিষ্ট শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল। তৎকালীন সিএমসি কামাল টেক্সটাইল নামের তালিকাভুক্ত কম্পানিটির মূল মালিকানা ছিল মুস্তফা কামালের। এভাবে শেয়ারদর বাড়াতে লোকসানি কম্পানি হওয়া সত্ত্বেও স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছিলেন তিনি। কম্পানির সম্পদ পুনর্মূল্যায়নের খবরে তখন শেয়ারের দর হু হু করে বেড়েছিল।

আবার রাইট শেয়ার বিক্রি করে মূলধন বৃদ্ধির খবরেও দর বেড়েছিল। ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারকে ভেঙে ১০ টাকার ১০টি শেয়ারে রূপান্তর করেও দর বাড়াতে সহায়তা করেন। কামাল এসব সুযোগ নিয়েছিলেন। এভাবে তাঁর কম্পানির শেয়ারদর অভিহিত মূল্যের তুলনায় ১৬ গুণ হয়ে যায়; একসময় যা অভিহিত মূল্যের তুলনায় অর্ধেকে কেনাবেচা হয়েছিল। এমন দর বৃদ্ধির পর কামাল এবং তাঁর পরিচালক সদস্যরা স্টক ডিভিডেন্ড হিসেবে পাওয়া শেয়ারগুলো প্রায় ২১ কোটি টাকা মূল্যে বিক্রি করেছিলেন।

ইব্রাহিম খালেদের তদন্তদলে এমন অভিযোগ আনা হলেও ঢাকা রিপোর্টার্স ফোরামের এক সংবাদ সম্মেলনে মুস্তফা কামাল সিএমসি কামাল কম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছিলেন। তিনি দাবি করেন, কম্পানিতে তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় থাকা মূল শেয়ারের একটিও বিক্রি করেননি। শুধু স্টক ডিভিডেন্ড হিসেবে পাওয়া শেয়ার বিক্রি করেছিলেন। তবে এক প্রশ্নের জবাবে কামাল স্বীকার করেন, শুধু বোনাস শেয়ার বিক্রি করে ২১ কোটি টাকা পেয়েছেন, যেখানে কম্পানিতে তাঁদের মোট বিনিয়োগ ছিল সাত কোটি টাকা। এমন বিপুল অঙ্কের মুনাফা পেতে শেয়ারদর বাড়ানোর সব আয়োজন করেছিলেন কি না—এমন প্রশ্ন তোলার পর তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন তিনি।

অভিযোগ আছে, শেয়ার কেনাবেচা করে বিপুল অঙ্কের মুনাফা করেছিলেন কামাল। ওই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে সমালোচনা এড়াতে কম্পানিটি আলিফ গ্রুপ নামের একটি ব্যাবসায়িক গ্রুপের কাছে বিক্রি করেন তিনি। এরপর সাবেক অর্থমন্ত্রী নিজ নামে শেয়ার ব্যবসা না করলেও মেয়ে নাফিসা কামাল নানা কারসাজি গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে শত শত কোটি টাকা মুনাফা করেছেন, যার বড় অংশ দুবাইয়ে পাচার করে সেখানকার রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় লোটাস কামালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে। তিনি তখন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। নানা অভিযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কোনো ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি লোটাস কামালকে। তাঁর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিঃস্ব হয়েছেন শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। লোপাট করে নেওয়া হয়েছে তাঁদের পুঁজি। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালে যখনই শেয়ার কারসাজি ও জাল-জালিয়াতির কথা উঠেছে তখনই ঘুরেফিরে সামনে চলে এসেছে এসব নাম। তাঁরা বাজার কারসাজিতে সহায়তা করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদগুলোতে নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়েছেন। এই চক্র একসঙ্গে মিলেমিশে শেয়ারবাজার থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা।

২০১০ সালের কারসাজিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামালের পকেটে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা গেছে বলে বিভিন্ন তদন্তে জানা যায়। ২০১০ সালের পর নিজে আর সরাসরি শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও পর্দার অন্তরালে জালিয়াতির কলকাঠি ছিল লোটাস কামালের হাতেই। তাঁর আশ্রয়-প্রশ্রয়, বুদ্ধি, পরামর্শ ও নেপথ্য সহযোগিতায় শেয়ারবাজারে একের পর এক কারসাজি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্তে লোটাস কামালের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়। সুপারিশ করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তাঁর বিরুদ্ধে। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হওয়ায় তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। পুরো শেয়ারবাজার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। শেয়ারবাজারে তাঁর পছন্দই ছিল শেষ কথা। নিজেদের কারসাজি চলমান রাখতে পছন্দের ব্যক্তিকে বানাতেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ও কমিশনার। তাঁদের মনোনীত কর্মকর্তারা কে কোন বিভাগে দায়িত্ব পালন করবেন সেসব ঠিক করে দিতেন তাঁরা।