
সারা দেশের কারাগারগুলো বন্দিতে ঠাসা। কারাগারের প্রতিটি কক্ষ বন্দিতে গিজগিজ করছে। বেশির ভাগ কারাগারেই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ বন্দি। খাবার, থাকার জায়গা, শৌচাগার, গোসল, চিকিৎসা সবকিছুতেই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বন্দিরা। দ্বিগুণ বন্দি হওয়ার কারণে ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারগুলোতে এই অবস্থা বিরাজ করলেও এ নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। কারা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দি বেশি হলেও বড় ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ৯০ হাজারের মতো বন্দি রাখার মতো ব্যবস্থা আছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রায় ৯২ হাজারের বেশি বন্দি কারাগারে ছিল। কিন্তু মানবাধিকার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কারাগারেও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ কারাগার রাষ্ট্রীয় হেফাজত। সেখানে কেউ থাকলে তার দায়িত্বও রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এ ছাড়া, বিনা কারণে যাতে কাউকে কারাগারে যেতে না হয় সেজন্য থানা পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগার মিলে ৬৯টি কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা ৪৩ হাজার ১৫৭। এরমধ্যে বন্দি আছে ৭০ হাজার ৫৬৫। ঢাকা বিভাগে ধারণক্ষমতা ১৩ হাজার ৫৮২। বন্দি আছে ২৫ হাজার ১০০। চট্টগ্রাম বিভাগে ধারণ ক্ষমতা ৭ হাজার। বন্দি আছে ১৪ হাজার। রাজশাহী বিভাগে ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৩০০। বন্দি আছে ৯ হাজার। সিলেট বিভাগে ধারণ ক্ষমতা ৪ হাজার ৫৮০। বন্দি আছে ৪ হাজার ৪৯৬। রংপুর বিভাগে ধারণক্ষমতা ৫ হাজার ১৮০। বন্দি আছে ৪ হাজার ৭০০। খুলনা বিভাগে ধারণ ক্ষমতা ৫ হাজার ৭০। বন্দি আছে ৬ হাজার ৪০০। বরিশাল বিভাগে ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ৯০০। বন্দি আছে ২ হাজার ৮০০। ময়মনসিংহ বিভাগে ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ৮০০। বন্দি আছে ৩ হাজার ৮০০। কারা অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৫৯০। কিন্তু বন্দি আছে প্রায় ৮ হাজার। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের ধারণক্ষমতা ১ হাজার। বন্দি আছে ২ হাজার ৪০০। চট্টগ্রাম কারাগারের ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ৮৫৩। বন্দি আছে ৫ হাজার। মহিলা কারাগারের ধারণ ক্ষমতা ২০০ হলেও বন্দি আছে ৫৪৬ জন।
‘রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’- এমন স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে কারা অধিদপ্তর। বন্দিদের বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা ও সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসনের জন্য উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা মনে করছেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি হলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। অল্প জায়গায় অনেককে হিজিবিজিভাবে থাকতে হয়। গোসল করা থেকে শুরু করে টয়লেটে যেতেও লাইন দিতে হয়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় চিকিৎসা নিতে। কারণ কারাগারে চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অথচ বেশির ভাগ বন্দি চুলকানি, জ্বর, শ্বাসকষ্টসহ আরও নানা অসুখে ভুগছেন। দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগা বন্দির সংখ্যাও প্রতিটা কারাগারে শত শত। কিন্তু সাধারণ বন্দিদের চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয় না। তবে, ভিআইপি বন্দিদের ক্ষেত্রে এ রকম সমস্যা হয় না। তারা চাইলে কারাগারের ভেতরে চিকিৎসা নিতে পারেন। প্রয়োজন হলে বাইরের হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন।
কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ৯২ হাজারের বেশি বন্দি ছিল কারাগারে। সেই তুলনায় এখন বন্দি কম। এখনো কারাগারে ২০ থেকে ৩০ হাজার বন্দি রাখা যাবে। কারণ কারাগারের ভেতরে বিভিন্ন সময় ভবন করা হয়েছে। সেখানেও বন্দি রাখা হয়। তবে কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দির থাকার জন্য ন্যূনতম ছয় ফুট করে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের জায়গা থাকতে হয়। দ্বিগুণ বন্দি থাকায় কারাগারে সেটা মানা সম্ভব হয় না। কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি রাখতে হয় বলে তারা কারাবিধি মানতে পারেন না। কারাগারে যথেষ্ট সংখ্যক কারারক্ষী না থাকায় শৃঙ্খলা রক্ষা করাও কঠিন। ৬৯টি কারাগারে চিকিৎসক মাত্র ছয়জন। ফলে বন্দিদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে কয়েকজন চিকিৎসক ঠিক করা আছে। তারা গিয়ে বন্দিদের চিকিৎসা করেন। প্রভাবশালী বন্দিরা অবশ্য চিকিৎসার জন্য দিনের পর দিন হাসপাতালে থাকার সুযোগ পান।
কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ, ফেনী ও মাদারীপুরে আরও তিনটি কারাগার চালু হবে। সেগুলো চালু হলে ধারণক্ষমতা আরও বাড়বে। তবে কারাগারে জনবল সংকট রয়েছে। প্রায় ১ হাজার ৮০০ পদ শূন্য। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় কিছু অব্যবস্থাপনা হচ্ছে। মাত্র ১১ হাজার জনবল দিয়ে ৭০ হাজারের বেশি বন্দিদের নিরাপত্তা ও দেখাশোনা করা হচ্ছে।
কারা অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) জান্নাত-উল ফরহাদ মানবজমিনকে বলেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি হলেও এটি খুব বেশি নয়। আমাদের আরও অন্তত ৩০ হাজার বন্দি রাখার ক্যাপাসিটি আছে। জনবল কম থাকায় কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। বেশ কিছু পদ শূন্য রয়েছে। সেগুলোতে জনবল নিয়োগ হলে সমস্যা থাকবে না। বন্দিদের চিকিৎসা নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব চিকিৎসক মাত্র ছয়জন। আর অন্যান্য কারাগারে সিভিল সার্জন চিকিৎসক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তারা কারাগারে গিয়ে চিকিৎসা করেন।